“কেন, বারণ কেন গো? আমি কি আর পুলিশের কাছে বলতে যাচ্ছি?”
“বললেই বা আটকাচ্ছে কে?”
দুঃখবাবু একটু দমে গিয়ে বললেন, “পুলিশও কি আর আমার কথা কানে তুলবে? আমাকে কেউ পোঁছে না, বুঝলে? কেউ পোঁছে না, অথচ আমার পেটে কত কথা জমে আছে। এসো, একটু গল্প করা যাক।”
চোরটা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, আমার কাজ আছে। আপনার এখানে তো কিছু হল না। খালি হাতে ফিরলে কি আমাদের চলে?”
চোরটা ফের ভাঙা জানলা দিয়েই পালিয়ে গেল। দুঃখবাবু বুকভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বললেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই?”
না, দুঃখবাবুর সত্যিই কেউ নেই। তাই দুঃখবাবু মনের দুঃখে মানুষ ছেড়ে অন্যদের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করতে লাগলেন। একটা নেড়ি কুকুর জুটল। তার নাম দিলেন ভুলু। তা ভুলু দুঃখবাবুর সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নিল। প্রায়ই এসে দরজার কাছে বসে, লেজ নাড়ে। দুঃখবাবু আদর করে বলেন, “ভুলু নাকি রে? ইস। বড্ড রোগা হয়ে গেছিস যে ভাই। সারা দুপুর টো-টো করে বেড়াস, অসুখবিসুখ করে ফেলবে যে।”
এইভাবে কথা চলতে থাকে। কিন্তু ভুলুর শুধু দুঃখবাবুকে নিয়ে চলে না। কারণ দুঃখবাবুর খাওয়াদাওয়া বড্ড সাদামাঠা। ডাল আর ভাত। ভুলু সুতরাং মাছ-মাংসওলা বাড়িতেও গিয়ে হানা দেয়।
ভুলু ছাড়া আরও দু-একজন বন্ধু জুটে গেল দুঃখবাবুর। ঘরের মধ্যে একজোড়া চড়াইপাখি বাসা করেছে। তাদের আবার ছানাপোনাও হয়েছে। দুঃখবাবু চড়াইপাখি দুটোর নাম দিয়েছেন হরিপদ আর মালতী। কিন্তু হরিপদ আর মালতী সারাদিন ভারী ব্যস্ত। চুড়ক করে উড়ে যাচ্ছে, ফুড়ত করে ফিরে আসছে। আবার যাচ্ছে, আসছে। তার ফাঁকে-ফাঁকে অবশ্য দুঃখবাবু তাদের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেন, “হরিপদ যে, শরীর ভাল তো! ছেলেপুলেরা সব কেমন আছে রে? বলি ও মালতী, কয়েক দানা মুড়ি বা চিড়ে খাবি? মুখোনা যে শুকিয়ে গেছে!”
কেঁদো চেহারার একটা ছুঁচো প্রায়ই দুঃখবাবুর ঘরে উৎপাত করে। দুঃখবাবু তার নাম দিয়েছেন হলধর। তাকে বিস্তর ডাকাডাকি করেন দুঃখবাবু, “বলি ও হলধর, শুনছিস? বেশ আছিস ভাইটি। মাটির তলায় ডুব দিয়ে থাকিস, দুনিয়ার কোনও ঝঞ্জাট পোহাতে হয় না। আর এই আমার অবস্থা দেখ। মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম বটে, কিন্তু মানুষের মতো কি বেঁচে আছি?”
বোলতা, ফড়িং, ব্যাঙ ইত্যাদির সঙ্গেও কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেন দুঃখবাবু। তবে বুঝতে পারেন, এরাও সব ভারী ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন বিষয়কর্মে ঘুরে বেড়ায়, রাতে একটু জিরোয়। দু দণ্ড বসে কথা শোনার সময় কারও নেই। তিনি যে একা সেই একা।
একদিন মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে তিনি বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বলে উঠলেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই?”
বলেই তিনি হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠলেন। ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিল কে? একেবারে স্পষ্ট সুড়সুড়ি। ভয় পেলেও ভাবলেন সেই চোরটা হয়তো ভাব করতে এসেছে। তাই কাঁপা গলায় বললেন, “চোরভায়া নাকি? অনেকদিন পর এলে।”
না, চোর নয়। বাতি জ্বেলে চারদিক ভাল করে দেখলেন তিনি। কেউ নেই। মনের ভুলই হবে হয়তো। আবার বাতি কমিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতেই ফের ঘাড়ে কে যেন সুড়সুড়ি দিল। এবার আরও স্পষ্ট। সাপখোপ বা বিছেটিছে নয় তো? তাড়াতাড়ি উঠে ভাল করে বিছানা-টিছানা হাঁটকে-মাটকে দেখলেন। কোথাও কিছু নেই। আবার শুলেন। চোখ বুজে মটকা মেরে রইলেন, ঘুম এল না। আচমকা মাথার চুলে কে যেন পটাং করে একটা টান মারল। “বাপ রে বলে উঠে বসলেন তিনি। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। ভূত নাকি? “রাম, রাম, রাম, রাম” বলতে বলতে ভয়ে কেঁদেই ফেলছিলেন তিনি। হঠাৎ মনে হল, আমার তো কেউ নেই। তা ভূতবাবাজির সঙ্গেই না হয় একটু বন্ধুত্ব হল!
গলাখাঁকারি দিয়ে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় দুঃখবাবু বললেন, “ভূত বাবাজি নাকি? আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক। এই অভাজনের কাছে যে আপনি আগমন করেছেন সেটা এক মস্ত সৌভাগ্যই আমার। দয়া করে কোনও বিকট চেহারা নিয়ে দেখা দেবেন না। আমি বড় ভিতু মানুষ।”
না, ভূত দেখা দিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখবাবু শুয়ে পড়লেন। রাতে আর কিছু হল না।
কিন্তু পরদিন হল। দুঃখবাবু শুয়ে আছেন। ঘুমটাও এসে গেছে। এমন সময়, না, সুড়সুড়ি নয়, কে যেন পেটে বেশ একটা রামকাতুকুতু দিল। দুঃখবাবুর বড্ড কাতুকুতুর ধাত। তিনি কাতুকুতু খেয়ে হেসে ফেললেন। তারপর “বাপ রে” বলে উঠে বসলেন। টের পেলেন ভয়ের চোটে তাঁর মাথার চুল খাড়া-খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
ভূত নাকি? ঘরে তো কেউ নেই! বসেবসে দুঃখবাবু বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ শুনলেন কিছুক্ষণ। এসব হচ্ছেটা কী? এসব হচ্ছে কেন? তিন গেলাস জল খেয়েও তাঁর গলাটা শুকনোই রইল। অনেকবার রামনাম করলেন।
ফের কাতুকুতুটা হল ভোরের দিকে। দুঃখবাবু প্রথমটা খিলখিল করে হেসে উঠেই ভয়ে খাড়া হয়ে বসলেন। আর ঘুম হল না।
কাতুকুতু বা সুড়সুড়ির ওপর দিয়ে মিটে গেলে কথা ছিল না। কিন্তু দিন-দুই পরেই দিনেদুপুরে যখন বাজার থেকে ফিরছিলেন তখন বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কে যেন পেছন থেকে পটাং করে একটা গাঁট্টা দিল। প্রথমটায় ভেবেছিলেন, কোনও দুষ্টু ছেলে ঢিল মেরেছে। কিন্তু ঢিল মারলে ঢিলটা মাটিতে পড়ার শব্দ হবে। হয়নি। ঢিল খেতে কিরকম লাগে তা দুঃখবাবু ভালই জানেন। অনেকবার টিল খেয়েছেন।