সদার মরেই যেত। কিন্তু বীরচন্দ্র এসে আটকাল, “কিঙ্কর, তোমাকে আমার দরকার। খুন করে জেলে গেলে তো আমার কাজ হবে না।”
ভজনলাল তাড়াতাড়ি এসে সর্দারকে বেঁধে ফেলল। বাঁধতে সে খুবই পটু। অন্যদের ইতিমধ্যেই বেঁধেছেদে পোঁটলা-পুটলির মতো সাজিয়ে রেখেছে একধারে।
মাধব এসে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে নিয়ে বললেন, “আরও একটু কাজ আছে। এদের আসল সর্দার ও-লোকটা নয়। আমাদেরই একজন। নইলে কে কোথায় লুকিয়ে পাহারা দিচ্ছে তা ওদের জানার কথা নয়। তা ছাড়া কিঙ্কর যে একটা গুপ্ত খবর জানে তাও বাইরের লোকের অনুমান করা শক্ত। সর্দার, বলো তো লোকটা কে?”
সদার বাঁধা অবস্থায় বলল, “জানি না।”
সঙ্গে-সঙ্গে কিঙ্করের একটা তো তার পেটে পড়তেই সে কোঁক করে উঠে বলল, “বলছি! বলছি!”
ভিড়ের ভেতর থেকে রায়বাবু এগিয়ে এসে বললেন, “কুলাঙ্গার, লাফাঙ্গা! একটা কোঁতকাও হজম করতে পারিস না? নাও বাবা ভজনলাল, আমাকেও বেঁধে ফেলো। তবে মারধোর কোরো না। ওসব হুডযুদ্ধ আমার সহ্য হয় না। আজ্ঞে হ্যাঁ, মাধববাবু, ঠিকই ধরেছেন। রাজামশাই মারা যাওয়ার সময় আমি ঘরের বাইরে ছিলাম। শঙ্করকে কিছু একটা বলতে দেখেছি, কিন্তু শুনতে পাইনি। সন্দেহটা তখন থেকে। শঙ্কর তারপর সেই যে হাওয়া হয়ে যায়, অনেকদিন বাদে এই মাসছয়েক আগে তার হদিস করতে পারি। আর আমার কিছু বলার নেই।”
ভজনলাল খুবই স্নেহের সঙ্গে রায়বাবুকেও বেঁধে ফেলল।
তারপর বলল, “এখুন এসব মাল কুথায় চালান হোবে ঘোষাল মহারাজ?”
“ভেবে দেখি। এখন সবাই বাড়ি যাও। রাত হয়েছে।”
মাধব দু’জনের ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করলেন। কিঙ্করের আঘাত গুরুতর। কিন্তু মস্ত মানুষ, মহা শক্তিমান। কাজেই প্রাণশক্তির জোরেই খাড়া থাকবে। বীরচন্দ্রের বাঁ হাতে দুটি গুলি লেগেছে। কিন্তু সেও সামলে যাবে।
একটু বাদে দুজনকে নিয়ে দরবার ঘরে এলেন মাধব। কিঙ্করকে বললেন, “তোমার স্মৃতিশক্তি ফিরে এসেছে তো!”
“যে আজ্ঞে। সিংহাসনের বেদির তলায় সোনা আছে এ-কথা বাবাই আমাকে বলে গিয়েছেন।”
কিঙ্কর গিয়ে শ্বেতপাথরের তৈরি বেদিটার সামনে দাঁড়াল। তারপর নিচু হয়ে বেদির ওপরের স্তরের যে-অংশটার কানা বেরিয়ে আছে সেই অংশটার কান ধরে সজোরে চাড় দিল। ভারী পাথর চড়চড় করে উঠে এল।
“দেখুন। “ মাধব এবং বীরচন্দ্র দেখলেন। পাথরের নীচে সোনার স্তর।
কিঙ্কর বলল, “গোটা বেদিটাই সোনার। চার থেকে পাঁচ মন সোনা ঢালাই করে তৈরি। ওপরে শ্বেতপাথর দিয়ে ঢাকা ছিল।”
বীরচন্দ্র অবাক হয়ে বলল, “এত সোনা! এ দিয়ে কী হবে?” মাধব হাসলেন, “কেন, তুমিই বলেছিলে টাকা থাকলে নবীগঞ্জের দুঃখ দূর করতে! তাই করবে। মানুষের হৃদয়ের রাজা হবে।”
বীরচন্দ্র বলল, “তবে তাই হোক।”
পরদিন ভোরবেলা ভারী সুন্দর করে রোদ উঠল। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। প্রজাপতি উড়ছে। গোরুর হাম্বা শোনা যাচ্ছে। হরিহরের পাঠশালায় ছেলেরা নামতা মুখস্থ করছে। পাঁচু পান্তাভাত খেতে বসেছে। হাবু ঘোষ খালে মাছ ধরছে। নিমাই-নিতাই দাঁতন করছে। বাসব দত্ত বন্দুকে তেল লাগাচ্ছে।
নয়ন বোস ম্যাজিক প্র্যাকটিস করছে। হরেন চৌধুরী গান গাইছে।
ওদিকে মাধব ডাকাতদের পুলিশের হাতে দিতে রাজি হননি। তাঁর বাড়িতে অনেকে জড়ো হয়েছে। একপাশে হাত-পা বাঁধা ডাকাতরা আর রায়বাবু লজ্জিতভাবে বসা। মাধব বললেন, “জেল খেটে কারও সংশোধন হয় না। আমি ওদের প্রস্তাব দিয়েছি নবীগঞ্জের উন্নতির জন্য বীরচন্দ্র যেসব কাজ করবেন তাতে এরা সবাই কায়িক শ্রম দেবে। পুকুর কাটা, রাস্তাঘাট তৈরি, নতুন স্কুলবাড়ি, হাসপাতাল, অনেক কাজ হাতে। কাজের ভেতর দিয়েই মানুষের সংশোধন হয়। কী হে, তোমরা রাজি তো! রায়বাবু কী বলেন?”
সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
সরকারমশাই সকালে বাজারে চলেছেন। পুঁটে সর্দারের সঙ্গে দেখা।
“এই যে ষষ্ঠীচরণ, তা খবর কী গো?” পুঁটে মাথা নেড়ে বলল, “না-না, বাজার আমার সকালেই হয়ে গেছে।”
বীরচন্দ্র স্থির করেছে, সে আর রাজবাড়িতে থাকবে না। রাজবাড়ি সংস্কার করে একটা কলেজ আর সংগ্রহশালা হবে।
বীরচন্দ্র এবার থেকে সাধারণ বাড়িতে অন্য পাঁচজনের মতো থাকবে।
রাত্রেই কথা হয়ে গেছে, কিঙ্কর আর দুঃখহরণ মিলে একটা কুস্তির আখড়া খুলবেন। নবীগঞ্জের ছেলেদের তালিম দেওয়া হবে সেখানে।
হেডসার এসেছেন দুঃখহরণবাবুর কাছে। হাত কচলে বলছেন, “এবারকার মতো দোষঘাট মাফ করে দিন দুঃখবাবু। আমাদের সকলের ইচ্ছে গেম-টিচারের পোস্টটা আপনিই নিন, তা হলে খেলাধুলোয় স্কুলের খুব নাম হবে।
দুঃখবাবু বললেন, “পরে ভেবে দেখব। আগে সামনের ওলিম্পিক থেকে কুস্তি আর ম্যারাথনের সোনার মেডেল দুটো নিয়ে আসি।” দুঃখবাবুর দুই বাঁদর ছেলে সকালে এসে খুব ভয়ে-ভয়ে বাবাকে প্রণাম করে গিয়ে লক্ষ্মীছেলের মতো পড়তে বসেছে। চণ্ডিকাঁদেবী একগলা ঘোমটা টেনে গরম লুচিভর্তি থালা নিয়ে এসেছেন। দুঃখবাবুর আর তেমন দুঃখ নেই।