বীরচন্দ্র একটা হুঙ্কার দিয়ে এগিয়ে যেতেই লোকটা দু কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু সে একা নয়। পেছনে আরও পাঁচ-পাঁচটা গুণ্ডা। বীরচন্দ্র হু-হুঁঙ্কারে তরোয়াল চালাতে লাগল বটে, লোকগুলো নাগালে এল না। একটা লোক পিস্তল তুলে দুবার গুলি চালিয়ে দিল।
বীরচন্দ্র জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।
সদার বলল, “আয়। এই সিঁড়ি দিয়ে ও উঠে এসেছিল। কিঙ্কর নিশ্চয়ই নীচে কোথাও আছে।”
কিঙ্করকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি দেরি হল না তাদের। পাতালঘরে নেমে মুখে টর্চের আলো ফেলতেই কিঙ্কর প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপরই সে হঠাৎ লোকটাকে দেখতে পেল। লম্বা, কালো, ভয়ঙ্কর দুটো চোখ।
“তুই! তুই!” বলতে বলতে কিঙ্কর লাফিয়ে উঠল। দু হাত মুঠো পাকিয়ে বলল, “তোকে… তোকে…”
কিন্তু কিঙ্কর দু পা এগনোর আগেই বন্দুকের কুঁদোর ঘা এসে পড়ল কাঁধের হাড়ে। একটা চেন বোঁ করে এসে লাগল তার কপালে। কিঙ্কর বসে পড়ল।
সদার এগিয়ে এসে বলল, “এবার বল তো, সোনা কোথায় আছে। লক্ষ্মীছেলের মতো বলে দে।”
“জানি না।”
“খুব ভালই জানিস। বুড়ো রাজা মরার সময় তোর বাবা তার কাছে ছিল। মরার আগে বিশ্বাসী লোক বলে তাকেই খবরটা দিয়ে যায়। বলেছিল, আমার ছেলে বড় হলে খুব অভাব কষ্টে পড়বে। তখন তাকে সোনার হদিসটা দিও। বলেছিল কি না?”
কিঙ্কর কপালে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, “আমি জানি। মনে নেই। তুই খারাপ লোক।”
সর্দার কিঙ্করের পাঁজরে একটা লাথি মেরে বলল, “বল। নইলে মরবি।”
কিঙ্কর ফের লাফিয়ে উঠে লোকটার গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু চারদিক থেকে বন্দুকের কুঁদো, চেন, মুগুর বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল তার মাথায়, কাঁধে, কপালে, শরীরের প্রায় সর্বত্র। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল কিঙ্কর।
“কোথায়? বল, নইলে…”
“জানি না। জানি না। জানি না। রা রাজু একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকে।”
“ওটা কোনও জবাব নয়। ঠিক করে বল।”
কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলে, “জানি না।”
“তোর বাবাকে কেন মেরেছিলাম জানিস? ঠিক এই অবাধ্যতার জন্যই। যখন তোর সামনেই তাকে গুলি করতে যাই তখনও আমার বিশ্বাস ছিল বাপকে বাঁচাতে তুই গুপ্ত খবরটা বলে দিবি। তুই বললি না, তোর বাপও মরল। এখনও যদি না বলিস তবে এবার তুই মরবি। মরতে চাস?”
“আমি জানি না। মনে পড়ছে না।”
সর্দার গম্ভীরভাবে বলল, “কেলো, ব্লেড চালা তো।”
কেলোর আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে ব্লেড ধরা। সে চকিতে এগিয়ে গিয়ে কিঙ্করের গালে আর দু হাতে হাতটা একবার বুলিয়ে দিল।
কিঙ্করের মুখ আর হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। আর একজন এগিয়ে গিয়ে একটা থলি থেকে একমুঠো নুন নিয়ে ছুঁড়ে মারল তার গায়ে।
কিঙ্কর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল। “এবার বল কিঙ্কর, নইলে কপালে আরও কষ্ট আছে।”
হঠাৎ দলের একটা লোক সর্দারের কানে কানে কী একটা বলল। সর্দার ভু কোঁচকাল। তারপর মাথা নাড়ল। বন্দুকটা তুলে কিঙ্করের দিকে তাক করে বলল, “এক থেকে তিন গুনব। তার মধ্যে বলা চাই। এক… দুই… তিন…”
তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ঘরে বন্দুকের একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ হল। ওপর থেকে চাপড়া খসে পড়ল। ঘরটা কেঁপে উঠল।
কিঙ্কর একটা অদ্ভুত ‘ওয়াঃ’ শব্দ করে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
সদার একটু হাসল, “এবার ব্যাটা বলবে। বন্দুককে খুব ভয় খায়।”
বলাই বাহুল্য, গুলি কিঙ্করের গায়ে লাগেনি, সর্দার শুধু ওর কানের পাশ দিয়ে গুলিটা চালিয়ে দিয়েছে।
মিনিট কয়েক বজ্রাহতের মতো পড়ে রইল কিঙ্কর। তারপর ধীরে-ধীরে চোখ মেলল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল। কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো চেয়ে থেকে হঠাৎ সে যেন শিউরে উঠে বলল, “রাজকুমার… বেদি… সোনা…”।
সদার মোলায়েম গলায় বলল, “বাঃ, এই তো স্মৃতি ফিরে আসছে দেখছি। আস্তে-আস্তে বল।”
কিঙ্কর কিছুক্ষণ সর্দারের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বিদ্বেগে উঠে দাঁড়াল, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই ধাক্কায় সবাইকে সরিয়ে চোখের পলকে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল ওপরে। তারপর দৌড়তে-দৌড়তে চিৎকার করতে লাগল, “রাজকুমার! রাজকুমার!”
সদার আর তার দলবলও উঠে এল ওপরে। বাইরে হাজার লোক তখন রাজবাড়ি প্রায় ঘিরে ফেলেছে। মাধব তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। যারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল তারাও সব গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে।
পুঁটে সর্দার বলল, “ঘোষালমশাই, বন্দুকের সামনে আমাদের সুবিধে হবে না। তবে একটা উপায় আছে। আমার এই লাঠিগাছ একসময়ে অনেক ভেলকি দেখিয়েছে। আজ বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু একবার চেষ্টা করতে পারি।”
বলেই পুঁটে সর্দার একটা হুঙ্কার ছেড়ে লাঠিটা বনবন করে ঘোরাতে-ঘোরাতে রাজবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। চেঁচাতে লাগল, “খবর্দার! খবর্দার!”
চু-কিত-কিত-কিত করতে করতে দুঃখবাবুও ঢুকে পড়লেন। একটু পেছনে বন্দুক হাতে বাসব দত্ত। তাঁর পেছনে ভজনলাল।
পেছনের সিঁড়ি দিয়ে তরোয়াল হাতে বীরচন্দ্রও নেমে এল। পেছনে কিঙ্কর।
সদার আর স্যাঙাতরা পরিস্থিতিটা একটু বুঝে নিয়েই বন্দুক তুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘটোৎকচের মতো পেছন থেকে তাদের ওপর এসে পড়ল কিঙ্কর। গোটা দলটা বেসামাল হয়ে যেতেই পটাপট লাঠি পড়তে লাগল। ভজনলাল আর পুঁটে মনের সুখে মারতে লাগল। দুঃখবাবু দুটোকে পেড়ে ফেললেন।
কিঙ্কর সর্দারকে দু হাতে তুলে আলাদা করে নিয়ে এল। তারপর তার গলা টিপে ধরে বলল, “তোর আজই শেষ রাত্রি।”