কিঙ্কর বলল, “আমার তরোয়াল লাগে না, হাতই যথেষ্ট।”
“আচ্ছা বেশ।”
যে ছ’জন রাজবাড়ির ফটকে পাহারা দিচ্ছিল, তারা হঠাৎ অবাক হয়ে শুনল, একটা লোক চুকিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে এদিকেই ধেয়ে আসছে।
“ওটা কে রে?”
“পাগল-ফাগল হবে। একটু আগে হাটখোলার কাছেও দেখেছি।”
“খুব বেআদপ তো।”
“বেআদপটা দৌড়ে এসে পড়ল সামনে। তারপর পট করে সামনের লোকটাকে একটা থাপ্পড় মেরেই পিছু ফিরে আবার চু-কিত-কিত করে ছুটতে লাগল। চড়-খাওয়া লোকটাও পিছু-পিছু ছুটে গিয়ে পটাং করে একটা লাথি কষাল লোকটাকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লোকটা লাথিটা এড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর লোকটাকে তুলে অনায়াসে একটা আছাড় মেরে হাত ঝাড়তে লাগল।
দৃশ্যটা দেখে বাকি পাঁচজনের মাথায় খুন চেপে গেল। তারা এমনিতেই খুনখারাপি করে বেড়ায়, একটা পেঁয়ো লোকের এহেন স্পর্ধা সহ্য করবে কী করে? “ধর, ধর ব্যাটাকে, লাশ ফেলে দিই।” বলে তারা পাঁচজন মিলে দুঃখবাবুকে তাড়া করল। দুঃখবাবু চুকিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে ফের ছুটতে লাগলেন। পাঁচজনের একজন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। দুঃখবাবু তাকে মাজা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়েই ল্যাং মেরে ফেলে দিলেন। লোকটা যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন বজ্ৰাদপি কঠোর একটা গাঁট্টাও বসিয়ে দিলেন মাথায়। গাঁট্টাটা মেরে তাঁর খুবই আনন্দ হল। এতদিনে তিনি ভূতের ঋণ শোধ করছেন।
বাকি চারজন কাণ্ডটা দেখে আর কাণ্ডজ্ঞান রাখতে পারল না। একজন পিস্তল তুলে ফটাস করে গুলি চালিয়ে দিল। দুঃখবাবু মাথাটা সরিয়ে নিয়ে গুলিটা পাশ কাটালেন। তারপর নিচু হয়ে তেড়ে গিয়ে লোকটাকে ঠিক বাজারের শিবের ষাঁড়টার মতোই একখানা তো মারলেন। লোকটা ছিটকে শূন্যে উঠে গেল। ওই অবস্থাতেই তার পেটে একখানা ঘুসি মারলেন দুঃখবাবু। তারপর ফের চুকিত-কিত করে দৌড় লাগালেন। তিনি যে এত প্যাঁচ-পয়জার জানেন তা তাঁর নিজেরও এতকাল জানা ছিল না।
বাকি তিনটে লোক হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে মারমার করে ধেয়ে আসছে। তাদের হাতে ছোরা, বোমা, বন্দুক। একটা লোক একটা বোমা বোধ হয় ছুঁড়েও মারল। সেটা দুঃখবাবুর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে এসে সামনে পড়তেই দুঃখবাবু সেটাকে ফুটবলের মতো একখানা শট করলেন। সেটা ফের উড়ে গিয়ে বোধ হয় রাস্তার ধারে কোনও খানাখন্দে পড়ল। কিন্তু ফাটল না। কিন্তু শটটা মেরে দুঃখহরণের আবার আনন্দ হল। তিনি কি ফুটবলও খেলতে পারেন তা হলে? শটটা তো মন্দ হল না!
তিনজনের একজন বড় গা ঘেঁষে এসে পড়েছে। দুঃখবাবু একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে পট করে হাত বাড়িয়ে একটা রদ্দা কষালেন তার ঘাড়ে। লোকটা কোঁক করে উঠল। দুঃখবাবু তার চুল মুঠো করে ধরে এক হ্যাঁচকায় তাকে হ্যামার থ্রোর ভঙ্গিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন পাশের খন্দে। রইল বাকি দুই।
দু’জনের একজনের হাতে ছোরা, অন্যজনের বন্দুক। কিন্তু কেউই অস্ত্র দুটো ব্যবহার করতে পারছে না ছুটতে হচ্ছে বলে। দুঃখবাবু দুজনকে দেখে নিয়ে মহানন্দে নানা রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে ছুটতে লাগলেন। কখনও জোরে, কখনও আস্তে। কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর দুঃখবাবু টের পেলেন লোক দুটো হেদিয়ে পড়েছে। সুতরাং তিনি এবার সোজা ছুটতে-ছুটতে মাধব ঘোষালের বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। পিছু-পিছু ফাতে-হাঁফাতে দুটো লোক।
“ঘোষালমশাই, এনেছি।”
“কাকে এনেছ?”
“এই দেখুন না?”
লোক দুটো এল টলতে টলতে। এসেই দড়াম-দড়াম করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।
দুঃখবাবু একগাল হেসে বললেন, “বড্ড হেদিয়ে পড়েছে।”
লোক দুটো এতই হেদিয়ে পড়েছে যে, হাপরের মতো শব্দ করে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিল। বন্দুক আর ছোরা হাত থেকে খসে পড়ে আছে সামনে। ভজনলাল তাড়াতাড়ি গোরুর দড়ি এনে দু’জনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।
দুঃখবাবু বললেন, “ঘোষালমশাই, রাজবাড়িতে কিন্তু একটা দল ঢুকে পড়েছে। তাড়াতাড়ি চলুন।”
“রাজবাড়িতে? রাজবাড়িতে কেন? তারা তো রাজুকে খুঁজছে!”
“তা জানি না, তাড়াতাড়ি চলুন।”
মাধব ঘোষাল কয়েক সেকেণ্ড ভাবলেন। তারপরই লাফিয়ে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! আমি তো মস্ত আহাম্মক, রাজু আসলে বোধ হয় রাজকুমার। পুরো কথাটা কিঙ্কর বলতে পারছিল না। বলেই বোধ হয় তোতলাচ্ছিল। সর্বনাশ!”
সবাই মিলে রাজবাড়ির দিকে ছুটতে লাগল।
পাতালঘরে অন্ধকারে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে বসে ছিল বীরচন্দ্র। পাশে কিঙ্কর। বীরচন্দ্রের হাতে নাঙ্গা তরোয়াল। ওপরে ভারী-ভারী পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। হঠাৎ করে যেন একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল।
বীরচন্দ্র সবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিঙ্কর, তুমি এখানেই থাকো। নোড়ো না, আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছ?”
“আমার বনমালী আর রাঁধুনির কথা খেয়াল ছিল না, ওরা বোধ হয় বিপদে পড়েছে।” বলেই বীরচন্দ্র সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলায় ছুটতে লাগল। ৮৬
কিন্তু ওপরের বারান্দায় উঠে আসতেই একেবারে মুখোমুখি কালান্তক যমের মতো একটা লোক। হাতে বন্দুক। বীরচন্দ্রের দিকেই তাক করা।
“তরোয়াল ফেলে দাও! আমরা বন্দুক চালাতে চাই না।”
বীরচন্দ্র বলল, “তোমরা বনমালী আর রাঁধুনিকে কী করেছ? বলো, নইলে শাস্তি পাবে।”
“ইস, রাজাগিরি দেখানো হচ্ছে! অ্যাঁ! রাজাগিরি! শাস্তি দেবে?”
বীরচন্দ্র আর থাকতে পারল না। লম্বা তরোয়ালটা বোঁ করে চালিয়ে দিল। তরোয়ালের ঘায়ে বন্দুকটা খসে পড়ল লোকটার হাত থেকে।