শরৎকালের এই সুন্দর সকালে রাজবাড়ির সরকারমশাই ভুজঙ্গ হালদার বাজারে চলেছেন। এক হাতে ছাতা, আর-এক হাতে চটের থলি। ভারী অন্যমনস্ক মানুষ। ছাতাটা হাতে ঝুলছে, থলিটা মাথায়।
রাজবাড়ির ভাঙা ফটকের সামনে দু’জনের দেখা হল। ভুজঙ্গবাবু আর পুঁটে সর্দার।
ভুজঙ্গবাবু ভূ একটু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বললেন, “এই যে বৃন্দাবনদাদা, চললে কোথায়?”
পুঁটে সদর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “না হে না, বাজারে যাব কেন? আমার বাজার কোন সকালে হয়ে গেছে। তা রাজবাড়ির খবরটবর কী, বলো!”
ভুজঙ্গবাবু হাত উলটে হতাশ গলায় বলেন, “খবর আর কি।
ওই গয়ংগচ্ছ করে চলছে। আদায়-উশুল উঠে গেছে, ঘটিবাটি বেচে চলছে কোনওরকমে।”
পুটে সর্দার চোখ বড় বড় করে বলল, “বলো কী! রাজবাড়িতে সাপ ঢুকেছিল? কতবড় সাপ?”
ভুজঙ্গবাবু বললেন, “তা সাপখোপেরও অভাব নেই। মেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুঁচো, ইঁদুর, বাদুড়, তক্ষক সবই পাবে। রাজবাড়িতে এখন ওদেরই বাস কিনা। দুঃখের কথা কী বলব রে ভাই জনার্দন, আজকাল চোর-ছ্যাঁচড়রা অবধি লজ্জায়-ঘেন্নায়রাজবাড়িতে ঢোকে না।”
“তাই নাকি? তা হলে তো খুব ভয়ের কথা হল! ভূত-প্রেতের উপদ্রব তো মোটেই ভাল কথা নয়। তা তুমি বাজারের থলিটা মাথায় চাপিয়েছ কেন গো? মাথাটা আবার গরম হল নাকি?”
জিভ কেটে ভুজঙ্গবাবু তাড়াতাড়ি থলি ঝুলিয়ে ছাতা খুলে মাথায় ধরে বললেন, “যাই, কচু-ঘেঁচু যা পাই নিয়ে আসি। রাজামশাই চাট্টি খাবেন।”
“না, না, আমার বাগানে এখনও লাউ ফলেনি। তবে কুমড়ো কিছু হয়েছে। ফলন মোটেই ভাল নয়। তা আসি গিয়ে। রাজামশাইকে আমার পেন্নাম জানিয়ো।”
ভুজঙ্গবাবু বললেন, “ইঃ, রাজামশাই! রাজা হতে মুরোদ লাগে। বুঝলে আজিজুলভায়া, রাজা শুধু মুখের কথায় হয় না।”
এই বলে ভুজঙ্গবাবু হনহন করে চলে গেলেন। পুঁটে সর্দার নিজের ন্যাড়া মাথায় খুশিমনে হাত বোলাতে-বোলাতে নবীগঞ্জের খবরাখবর নিতে চলল। আজ মনটা খুশিতে একেবারে টাকডুমাডুম। যেদিন ন্যাড়া হয় সেদিনটায় ভারী আনন্দ হয় তার।
নবীগঞ্জের সবচেয়ে দুঃখী লোক হলেন দুঃখহরণ রায়। ছোটখাটো, দুর্বল, ভিতু এই মানুষটি একসময়ে নবীগঞ্জের স্কুলে মাস্টারি করতেন। কিন্তু ছেলেরা তাঁর কথা মোটেই শুনত না, ক্লাসে ভীষণ গণ্ডগোল হত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেডসার প্রতাপচন্দ্র মার্কণ্ড অবশেষে দুঃখবাবুকে ডেকে বললেন, “এভাবে তো চলতে পারে না। আপনি বরং কাল থেকে আর ক্লাস নেবেন না, কেরানিবাবুকে সাহায্য করবেন। ওটাই আপনার চাকরি।”
দুঃখবাবু একথায় খুব দুঃখ পেয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তাঁর দজ্জাল স্ত্রী চণ্ডিকা এতে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দুঃখবাবুকে খুব কড়া কড়া কথা শোনাতে লাগলেন দুবেলা। দুঃখবাবু অগত্যা বাড়ির বাইরের দিকে একখানা খোঁড়া ঘর তুলে আলাদাভাবে বাস করতে লাগলেন। তাঁর দুটো ছেলে রাম আর লক্ষ্মণ নবীগঞ্জের কুখ্যাত ডানপিটে দুষ্টু ছেলে। তাদের অত্যাচারে লোকে জর্জরিত। একে মারছে, তাকে ধরছে, ফল-পাকুড় চুরি করছে, গাছ বাইছে, যখন-তখন যাকে-তাকে দূর থেকে ঢিল মেরে পালাচ্ছে। তাদের সামলানোর সাধ্যও দুঃখবাবুর নেই। কিন্তু লোকে এসে তাঁকেই অপমান করে যায়। দুঃখবাবু মাথা নিচু করে অপমান নীরবে হজম করেন। হতদরিদ্র, মুখচোরা দুঃখবাবুকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। একা-একা থাকেন। একা থাকতে-থাকতে নিজের মনেই নানা কথা বলেন। কখনও আপনমনে হাসেন। কখনও মনখারাপ করে বেজার মুখে বসে থাকেন। মাঝে-মাঝে খুব হতাশ হয়ে বলেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই?”
একদিন রাতের বেলা চোর এল। ঘরে খুটখাট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে উঠে বসলেন দুঃখবাবু। কাঁপা গলায় বললেন, “কে হে বাপু? আমি বড় ভিতু মানুষ।”
চোরটি লাইনে নতুন। পুরনো চোর হলে কখনও দুঃখবাবুর ঘরে ঢুকত না। আর ধরা পড়লে ভয়ও পেত না।
কিন্তু আনাড়ি চোরটি ভয় পেল এবং ভাঙা জানলা দিয়ে পালাতে গিয়ে বাখারির খোঁচা খেয়ে ‘বাপ রে’ বলে বুক চেপে ধরে বসে পড়ল মাটিতে। দুঃখবাবু তাড়াতাড়ি আলো জ্বেলে দেখেন জানলার ভাঙা বাখারির খোঁচায় চোরটার বুকে বেশ ক্ষত হয়েছে।
দুঃখবাবু দুঃখিতভাবে বললেন, “পালানোর কোনও দরকারই ছিল না তোমার। আমি কি তোমাকে মারতুম রে ভাই? আমার গায়ে জোরই নেই। দেখছ না আমার কেমন রোগা-রোগা হাত-পা? কস্মিনকালে কেউ আমাকে ভয় খায়নি। দাঁড়াও আমার কাছে একটা মলম আছে, লাগিয়ে দিচ্ছি। তারপর একটু জলবাতাসা খাও, জিরোও।”
চোরটার ক্ষতে মলম লাগানো হল। খুবই লজ্জার সঙ্গে জলবাতাসাও সে খেল। কিন্তু খুব গুম হয়ে রইল। নিজের আনাড়িপনার জন্যও বোধ হয় লজ্জা হয়েছে। বয়সটাও বেশি নয়। দুঃখবাবুর চোরটাকে বেশ ভালই লাগল। লোকটার সঙ্গে একটু কথাটথা বলতে ইচ্ছে করছিল। দুঃখের বিষয়, দুঃখবাবুর সঙ্গে কেউই বিশেষ কথাটথা বলতে চায় না। অথচ দুঃখবাবুর খুব ইচ্ছে করে একজন বেশ সহৃদয় লোককে বসেবসে নিজের দুঃখের কথা শোনান।
দুঃখবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে আলাপ শুরু করলেন, “ওহে বাপু, অমন বেজার হয়ে থেকো না। আমি যে লোকটা খারাপ নই তা তো টের পেলে। তোমার ওপর আমার কোনও রাগও নেই। তা তোমার বাড়ি কোথায়? নাম কী?”
চোরটা একটু নড়েচড়ে বসে বলল, “ওসব বলা বারণ আছে।”