ঝোঁপের আড়াল থেকে দুটো ছায়ামূর্তির মতো তোক বেরিয়ে এল। একজন ভারী গলায় বলল, “পাহারা দিচ্ছিল। হুঁ, খুব পাহারাদার।”
অন্যজন পা দিয়ে ভল্লনাথকে একটু নেড়েচেড়ে বলল, “এটা বোধ হয় ব্যায়ামবীর, দেব নাকি গলার নলিটা কেটে?”
“দুর, মশামাছি মেরে কী হবে? আমাদের দরকার কিঙ্কর জাম্বুবানটাকে। তাকে না পেলে এত পরিশ্রমই বৃথা।”
“রাজবাড়িটা কোথায়?”
“এসে গেছি, চণ্ডীমণ্ডপ ছাড়িয়ে দক্ষিণে।” বলে লোকটা একটা শিস দিল। সঙ্গে-সঙ্গে পালটা কয়েকটা শিস শোনা গেল।
নেতাজির মূর্তির চারধারে তখন একটা গোল্লাছুট খেলা চলছে। নয়ন বোস প্রাণভয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, পেছনে মুগুর। হাতে একটা লোক। মুগুরের ঘায়ে আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে হরিহর পণ্ডিত। নয়নের কপাল খারাপ। হরিহর পণ্ডিতকে ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে বেশ দৌড়চ্ছিল এতক্ষণ, কিন্তু হঠাৎ তার গায়েই হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। গদাম করে মুগুরটা এসে লাগল মাথায়। নয়ন বোস চোখে সর্ষেফুল দেখতে-দেখতে অজ্ঞান হয়ে গেল। হাটখোলার অবস্থা আরও খারাপ। বস্তাচাপা হাবু ঘোষ হঠাৎ নাকে ধুলো ঢুকে হেঁচে ফেলার পর একটা লোক ছুটে এসে একখানা ঘেঁটে লাঠি দিয়ে বস্তাগুলোকে আচ্ছা করে পিটে দিয়ে গেল। দুটো বস্তাই আলুর বস্তার মত নিথর হয়ে পড়ে রইল।
নিমাই, নিতাই আর বাসব দত্ত রাজবাড়ির ফটকের মস্ত থামটার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে, একটু পেছনে পাঁচু ঘোরাঘুরি করছে। হঠাৎ পাঁচু একটু উৎকর্ণ হয়ে কী-একটু শুনে চাপা গলায় বলল, “এসে গেছে!”
বাসব বলল, “কে এসেছে?”
“তেনারা, শিস দেওয়ার শব্দ শুনলেন না?”
“শিস দেবে কেন?”
“ওটা ইশারা।”
“তা হলে এখন কী করব?”
“বন্দুকটা ফোঁটান। বন্দুক ফোঁটালে ভয় পেতে পারে।” বাসব নিজেই ঠকঠক করে কাঁপছে। বন্দুকটা তুলে কোনওরকমে আকাশমুখো করে ঘোড়াটা টিপতে যাবে, ঠিক এমন সময় একটা আধলা ইট এসে কপালে লাগল। বাসব দত্ত তার বন্দুকসমেত শুয়ে পড়ল ঘাসে। বন্দুকটাকে একেবারে পাশবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে। প্রথম লাঠির চোটেই “বাপ রে” বলে বসে পড়ল নিমাই। তারপর বাসব দত্তর পাশেই গড়িয়ে পড়ল। নিতাই কিছুক্ষণ মুগুরপেটাই হয়েও দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর কাটা কলাগাছের মতো বাসব দত্তের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।
লোকগুলো খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নিপাটে পড়ে-থাকা মানুষগুলোর দিকে চেয়ে ছিল। একজন বলল, “এরা আগে থেকে নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। নইলে পাহারা রাখত না।”
সবচেয়ে লম্বা কালোমতো বিকট চেহারার সর্দার চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “আরও একটা লোক ছিল, সে পালিয়েছে। সে গিয়ে গাঁয়ের লোককে ডেকে আনতে পারে। কয়েকজন নীচে পাহারায় থাক। এতক্ষণ গুলি, বোমা চালানো হয়নি; কিন্তু যদি গাঁয়ের তোক বাধা দিতে আসে তা হলে ঝাঁঝরা করে দিবি। আমাদের কাজে একটু সময় লাগবে।”
একটা লোক বলল, “কিন্তু কালু, কিঙ্করকে না পেলে তো
জিনিসটার হদিস পাওয়া যাবে না।”
“কিঙ্কর রাজবাড়িতেই আছে, খবর পেয়েছি। রাজবাড়িতে আগে যা বাজার হত এখন তার তিনগুণ হচ্ছে। তার মানে একজন খুব খানেওলা লোক এখানে লুকিয়ে আছে। কিঙ্কর ছাড়া কে?”
সবাই চাপাস্বরে বলে উঠল, “ঠিক কথা।“
সর্দার একটা লোকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “কেষ্ট, তুই কত বড় বোকার মতো কাজ করেছিস জানিস? শঙ্কর পালোয়ানকে মেরেছিলাম বাধ্য হয়ে, সে কিছুতেই কবুল করেনি। তারপর রাগের চোটে কিঙ্করকেও মারতে গিয়েছিলি। কিঙ্কর মরে গেলে ওই সোনার হদিস পাওয়া যেত? বেঁচে আছে বলে রক্ষে। তাও কথা বের করা যাবে কিনা জানি না। স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে শুনেছি। কিন্তু এখন আর কথা বলার সময় নেই। জনাছয়েক পাহারায় থাক। পাঁচজন আমার সঙ্গে ওপরে আয়।”
সর্দারের পিছু পিছু যে পাঁচজন রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তাদের একজন বলল, “আচ্ছা সর্দার, স্মৃতিভ্রংশ হয়ে থাকলে কিঙ্করের কাছ থেকেই বা সোনার হদিস পাবে কেমন করে?”
“মারের চোটে মড়াও কথা বলে। তবে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে একপক্ষে ভালই হয়েছে। নইলে হয়তো রাজপুত্তুরটাকেই সব বলে দিত।”
“বলেনি তা কী করে জানলে?”
“আমার আরও চোখ আছে রে। সব খবর পাই।”
দোতলার ঘরে বীণা বাজাচ্ছে বীরচন্দ্র, মোহিত হয়ে শুনছে কিঙ্কর। হঠাৎ বীণা থামিয়ে বীরচন্দ্র উৎকর্ণ হল, তারপর বীণাটা রেখে বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে বলল, “কিঙ্কর, লুকোতে হবে।”
কিঙ্কর একটু যেন অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
“বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। এসো আমার সঙ্গে।” কিঙ্কর হঠাৎ শক্ত হয়ে মুঠো পাকিয়ে বলল, “সেই লোকটা? তাকে আমি পিষে ফেলব।”
বীরচন্দ্র ম্লান হেসে বলে, “তার আগে আত্মরক্ষা করা দরকার। আর সময় নেই। এসো। নীচে দরজায় শব্দ পাচ্ছি যেন। ওরা বাইরে থেকেই দরজা খুলতে জানে বোধ হয়। এসো।”
দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এল। বীরচন্দ্র ডান দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কিঙ্করকে নিয়ে আর-একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে একতলায় এল। তারপর চোরাকুঠুরির দরজা খুলে নেমে এল পাতাল ঘরে। এখানে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার আর সোঁদা গন্ধ। ইঁদুরের দৌড়োদৌড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
“কিঙ্কর, ভয় করছে না তো?”
“না।”
“শব্দ কোরো না।”
চোরাকুঠুরিতে দুখানা তরোয়াল আগে থেকেই রেখে গেছে বীরচন্দ্র। অন্ধকারেই হাতড়ে-হাতড়ে তোয়াল দুটো খুঁজে নিয়ে একখানা কিঙ্করের হাতে দিয়ে বলল, “এটা রাখো। খুব দরকার না হলে ব্যবহার কোরো না।”