ভজনলাল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “আরে রামভাই, ইয়ে তো খতরনাক জায়গা ভৈল বা। কাল ভি এক বদমাশ আয়া থা। আজ বারা বদমাশ?”
নাঃ, ভজনলালকে ভাবিত হতেই হচ্ছে। ট্রেনটা পাস করিয়ে সে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে রুটি খেয়ে মোটা বাঁশের লাঠিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একবার মাধব ঘোষালের কাছে যাওয়া দরকার। স্টেশনে নতুন কোনও লোক নামলে খবরটা দিতে বলেছেন মাধব।
ওদিকে নবীগঞ্জে রাত-পাহারা শুরু হয়েছে। নবীগঞ্জ বড় জায়গা। অনেকটা ছড়ানো এলাকার সবটা পাহারা দেওয়ার মতো লোক পাওয়া যায়নি। দুটো ব্যাচ হয়েছে। আজ এক ব্যাচ পাহারা দেবে, কাল আর-এক ব্যাচ। সবাই না ঘুমিয়ে পাহারা দিলে দু’দিনেই সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তাই এই ব্যবস্থা। ব্যাচ ভাগ হওয়ায় পাহারা দেওয়ার লোকও অর্ধেক হয়ে গেছে। চারজন-চারজন করে ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাধব বলে দিয়েছেন, সাড়াশব্দ করা চলবে না। সবাই যেন গা-ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। দুঃখবাবুর ওপর ভার পড়েছে, দৌড়ে-দৌড়ে প্রত্যেকটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার এবং মাঝে-মাঝে এসে মাধবকে খবর দিয়ে যাওয়ার। এই প্রস্তাবে দুঃখবাবু দুঃখিত হননি। দৌড়তে তাঁর ভালই লাগছে। বেশ চাঙ্গা বোধ করছেন। রসুলপুরে আজ সকালে কুস্তি লড়ার পর তাঁর জীবনে যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা, গাঁট্টা, কাতুকুতু ইত্যাদি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। গাঁট্টার ভয়ে নয়, এখন তিনি মনের আনন্দেই সারা নবীগঞ্জ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। জীবনে খেলাধুলো করেননি, আজ রাতে দৌড়তে-দৌড়তে কবাডি খেলুড়ের মতো চু-কিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে একবার রাজবাড়ির ফটকের পাশের ঝোপে লুকনো বাসব দত্ত বা নিমাই আর নিতাইকে ছুঁয়ে আসছেন, কখনও বোসপাড়ার মোড়ে নেতাজির স্ট্যাচুর পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা নয়ন বোস আর হরিহর পণ্ডিতকে ছুঁয়ে আসছেন, কখনওবা হাটখোলায় বস্তাচাপা দেওয়া হাবু ঘোষ আর পুঁটে সর্দারের পিঠে চাপড় মেরে আসছেন, কখনও বা চণ্ডীমণ্ডপের কলাঝাড়ের পেছনে গা-ঢাকা দেওয়া ব্যায়ামবীর ভল্লনাথ আর হরেন চৌধুরীকে চিমটি কেটে আসছেন। মনে আজ তাঁর ভারী আনন্দ।
নাগরা জুতোর শব্দ তুলে হন্তদন্ত হয়ে পয়েন্টসম্যান ভজনলাল যখন এসে বারোজন ডাকুর খবর দিল, তখন মাধব সচকিত হলেন। বললেন, “এসে গেছে?”
“আ গিয়া নেহি, ঘুস গিয়া, ডাকুলোগ সব ঘুসিয়ে পড়েছে। ডাল রুটি সেবা করতে আমার কুছু সোময় লেগেছিল, উসি সোময় ডাকুলোক ঘুসিয়ে পড়েছে।”
ওদিকে রাজবাড়িতে দোতলার ঘরে কিঙ্কর চেয়ারে বসে শুনছে আর বিছানায় বসে বিভোর হয়ে বীরচন্দ্র বীণা বাজাচ্ছে। কিঙ্করের চোখে একটা মুগ্ধতা লক্ষ করছে বীরচন্দ্র। বীণা কি ওর স্মৃতিশক্তির ওপর কাজ করবে? কে জানে!
একটা রাগ শেষ হতেই কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “বীণা খুব ভাল জিনিস।”
“হ্যাঁ। খুব ভাল। অভাবকষ্ট সব ভুলে যাওয়া যায়।” কিঙ্কর হঠাৎ বলল, “বাবা কিন্তু ওদের বলেনি।”
“কী বলেনি?”
“যেকথাটা ওরা জানতে চেয়েছিল।”
“কোন কথা বলল তো?” কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলল, “তা, জানি না।”
বীরচন্দ্র একটু হেসে বলল, “রাজু একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকে, এই কথা তো?”
কিঙ্কর সবেগে মাথা নেড়ে বলে, “হাঁ, হ্যাঁ। বাবা বলেনি।”
বীরচন্দ্র হেসে বলল, “বললেইবা কী ক্ষতি হত বলো? আমরা রাজুকেও চিনি না, তার উঁচু জায়গা কোথায় তাও জানি না। ওসব কথা থাক। বীণা বাজাই, শোনো।”
কিঙ্কর ফের মন দিয়ে শুনল। বীণা থামতেই বলল, “ওরা রাজুকে খুন করবে। ওরা খারাপ।”
ওদিকে দুঃখবাবু হাটখোলায় বস্তাচাপা দেওয়া হাবু ঘোষকে একটা চাপড় মেরেই ফের ছুটতে যাচ্ছেন, সামনে চারজন লোক পথ থেকে সাঁত করে সরে যাচ্ছিল। দুঃখবাবু চুকিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে তাদের দুজনকে ছুঁয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, “সজাগ থেকো, সজাগ থেকো। ভাল করে পাহারা দাও। ঘুরে বেড়িও না।”
বলেই আবার চুকিত-কিত-কিত-কিত করে ছুটতে শুরু করলেন। খানিকদূর গিয়েই তাঁর হঠাৎ মনে হল, আরে! তিনি কাঁদের ছুঁয়ে এলেন? অন্ধকারেও তিনি যাদের দেখেছেন তারা কি নবীগঞ্জের মানুষ? মনে হতেই দুঃখবাবু পট করে ঘুরে হাটখোলার দিকে ফিরে এলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না।
“হাবু, হাবু?”
হাবু কম্পিত গলায় বলল, “কী বলছ?”
“কিছু দেখেছ?”
“খুব দেখেছি। দেখে ভয়ে হিম হয়ে আছি।”
“সর্বনাশ!” বলে ফের ছুটতে লাগলেন দুঃখবাবু।
“ঘোষালমশাই, তারা ঢুকে পড়েছে।”
“জানি। কোনদিকে যায় একটু বুঝতে চেষ্টা করে। তারা রাজু নামে কাউকে খুঁজছে। রাজুটা যে কে, তা তো বুঝতে পারছি না। ওদের ওপর নজর রাখো।”
“যে আজ্ঞে।” বলে দুঃখবাবু দৌড় শুরু করে দিলেন।
কলাঝাড়ের পেছনে ভল্লনাথ হঠাৎ হরেন চৌধুরীকে চাপাস্বরে বলল, “ও মশাই, চিমটি কাটছেন কেন?”।
“কে চিমটি কাটছে? কী যে বলো না, কিছু ঠিক নেই।”
“এই তো কাটলেন!”
“তোমার মাথাটাই গেছে।”
“তবে কে কাটল?” বলে ভল্লনাথ পেছনে ঘাড় ঘুরিয়েই হঠাৎ ‘বাপরে বলে’ দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে গেল, কিন্তু পারল না। কাটা কলাগাছের একটা গোড়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে তার দাঁতকপাটি লাগল। হরেন চৌধুরী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘোরাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আর দরকার হল না। মাথায় ঠাস করে কী একটা বস্তু এসে লাগতেই মূর্ছা হয়ে গড়িয়ে পড়লেন।