কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “রাজু একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকে।”
মাধব আবার ঝুঁকে বললেন, “উঁচু জায়গা? কীরকম উঁচু জায়গা?”
“তা জানি না।”
“পাহাড়? টিলা?”
“ভুলে গেছি।” মাধব আর-একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বনমালী এসে খবর দিল, রায়বাবু দেখা করতে এসেছেন।
মাধব ভ্রূ কুঁচকে বীরচন্দ্রের দিকে চেয়ে বললেন, “রায়বাবুর সঙ্গে তোমার আলাপ আছে নাকি?”
বীরচন্দ্র বলল, “না, ঠিক আলাপ নেই। তবে মাসদুয়েক আগে আর-একবার উনি এসেছিলেন। কুশল প্রশ্ন করে গিয়েছিলেন।”
বীরচন্দ্র কিঙ্করকে কোণের ঘরে রেখে এল। তারপর বনমালীকে বলল, “নীচের বৈঠকখানায় বসাও। আমি যাচ্ছি।”
মাধব বললেন, “তুমি একাই যাও। আমি যে এখানে আছি তা বলার দরকার নেই।”
“তাই হবে।” বলে বীরচন্দ্র চলে গেল।
রায়বাবু খুবই অমায়িক মানুষ। বীরচন্দ্র বৈঠকখানায় ঢুকতেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন।
বীরচন্দ্র লজ্জা পেয়ে বলল, “আপনি উঠলেন কেন? বসুন।”
রায়বাবু হাতজোড় করে বললেন, “মানীর মান রক্ষা করতে হবে না? বয়সে ছেলেমানুষ হলে কী হয়, আপনি যে রাজা তা ভুলি কী করে?”
বীরচন্দ্র হেসে ফেলল। রায়বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “মরা হাতি লাখ টাকা।”
মুখোমুখি বসে বীরচন্দ্র বলল, “রাজাদের দিন চলে গেছে। আমি আর রাজাটাজা নই।”
রায়বাবু একটু হেসে বললেন, “সে তো আপনি বলবেনই। তবে শুনেছি রাজদর্শনে পুণ্য হয়। তা শরীরগতিক সব ভাল তো?”
“ভালই।”
“এদিকে গাঁয়ে যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সে-বিষয়ে আপনি কিছু শুনেছেন?”
বীরচন্দ্র অবাক হয়ে বলে, “কিসের আতঙ্ক?”
“আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু নবীগঞ্জের অনেকেই তাকে কাল রাতে দেখেছে। দৈত্য বা রাক্ষস কিছু একটা। দৈত্য বা রাক্ষসের অস্তিত্ব নেই, জানি। কিন্তু এত লোকে যখন বলছে তখন কিছু একটা হবেই। আপনি কিছু শোনেননি?”
বীরচন্দ্র একটু হাসল। বলল, “শুনেছি। তবে গুরুত্ব দিইনি।”
“তাকে কিন্তু আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুবই আশ্চর্যের বিষয় নয়?”
“হয়তো পালিয়ে গেছে।”
রায়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “পালিয়ে গেছে! কিন্তু সে যে একজনকে খুঁজতে এসেছিল। যাকে খুঁজছে তাকে খুন করতেই এসেছে সে। কিন্তু তার চেহারা কেমন, নাম কী, কিছু বলতে চাইছে না। ব্যাপারটা খুবই ভয়ের হয়ে দাঁড়াল। কাকে খুনটুন করে বসে তার ঠিক কী?”
বীরচন্দ্র একটু চুপ করে থেকে বলল, “শুনেছি গাঁয়ে আজ রাত থেকে পাহারা দেওয়া হবে। সবাই সতর্ক থাকলে তত ভয়ের কিছু নেই।”
“আমি একটু ঘাবড়ে গেছি। কাল রাতে আমার বাড়িতে কেউ এসেছিল। আমার কুকুরকে ওষুধমেশানো মাংস খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে চুরির চেষ্টা করেছিল। বাগানে খুব ভারী আওয়াজও শুনেছি। ভাবছি কদিনের জন্য নবীগঞ্জ ছেড়ে বাইরে গিয়ে থেকে আসব।”
বীরচন্দ্র হাসল। বলল, “সেটাও একটা সমাধান বটে!” রায়বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “রাজবাড়িতে কি চোরটোর হানা দেয় না?”
বীরচন্দ্র ঠোঁট উলটে বলল, “দেয় হয়তো। তবে রাজবাড়িতে তো কিছু নেই। সবাই জানে।”
“তবু আপনার সতর্ক থাকা ভাল। সেই রাক্ষসটাই যদি হানা দেয় তা হলে কী করবেন?”
“তা তো জানি না।”
“অনেকে বলে, আপনি নাকি গভীর রাতে বীণা বাজান। এ-কথা কি সত্যি?”
লাজুক বীরচন্দ্র মুখ নামিয়ে হেসে বলল, “ওইটেই আমার সময় কাটানোর উপায়।”
“ভাল। কিন্তু অত নিশ্চিন্ত থাকা ভাল নয়। একটু সতর্ক থাকবেন।”
বীরচন্দ্র বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আচ্ছা।”
রায়বাবু তাঁর রুপোবাঁধানো লাঠিটা তুলে পাশের একটা বন্ধ দরজার দিকে নির্দেশ করে বললেন, “ওটা কিসের ঘর বলুন তো?”
বীরচন্দ্র লজ্জায় একটু লাল হয়ে বললেন, “ওটা একসময়ে দরবার ছিল।”
“দরবার! বাঃ, বেশ। তা সিংহাসন-টন নেই এখন?”
বীরচন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “না। অনেকদিন আগেই সব বিক্রি হয়ে গেছে।”
“ঘরটা তালাবন্ধ থাকে বোধ হয়?”
“হ্যাঁ। তবে ভোলা রাখলেও ক্ষতি নেই। ইঁদুরবাদুড় ঢুকবে বলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।”
“অ।” বলে রায়বাবু উঠে পড়লেন।
৪. রাত দশটার ট্রেনটা
রাত দশটার ট্রেনটা আজ স্টেশনে ঢোকার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হুইল মারতে লাগল কুককুক কুউক, কুক-কুক কুউক। ভজনলাল বিরক্ত হল। কেউ চেন টেনে ট্রেন থামিয়েছে। ওদিকে ঘরে তার ডাল-রুটি আর তাড়সের তরকারি ঠাণ্ডা হচ্ছে। খিদেও পেয়েছে খুব। ট্রেনটা পাস না করিয়ে ঘরে যায় কী করে ভজনলাল?
সুতরাং ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল ভজনলালকে। চেন টানলে অনেক বখেরা। গার্ডসাহেব নামবেন, প্রত্যেকটা কামরার ছাদের কাছে ফিট করা অ্যালার্ম সিগন্যালের ডাঁটিটা বেরিয়ে আছে কিনা দেখবেন, সম্ভব হলে অপরাধীকে ধরে ফাইন করবেন, তারপর ডাঁটিটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলে তবে ট্রেন চলবে। খিদের মুখে দেরিটা সহ্য হচ্ছিল না ভজনলালের। কিন্তু কী আর করা! সে একটা বেঞ্চে বসে দেহাতি গান গাইতে লাগল, ‘রামভজন করো জ্ঞানী, রামভজন করো ধ্যানী, রামভজন করো প্রাণী, দো দিন কা জিন্দগানি…’
হুইল মেরে ট্রেনটা অবশেষে চলল এবং বিস্তর কাঁচকোঁচ শব্দ করে এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল। ড্রাইভার রামসেবক তেওয়ারি বন্ধু লোক। লাইন ক্লিয়ারটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভজনলাল জিজ্ঞেস করল, “ক্যা ভৈল হে রামভাই?”
রামসেবক জবাব দিল, “দশবারা বদমাশ উঠা থা টিরেন মে। চেন খিচকে জঙ্গলমে উতার গয়া। ডাকু-উকু মালুম হোতা।”