দুঃখবাবু শঙ্কর সেনাপতির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। নামটা শুনে মনে পড়ল। বললেন, “দ্যাখো ভাই, আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি। শঙ্কর সেনাপতি কীভাবে খুন হল, তা কেউ জানো?”
একজন বলল, “খুনটা হয়েছে মাঝরাতে। কেউ তখন জেগে ছিল না। বন্দুকের শব্দে যখন পাড়া-প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিঙ্করের মাথায় চোট হয়েছিল। তাকে হাসপাতালে আমরাই নিয়ে যাই। তবে সে বেঁচে গেছে।”
“সে এখন কোথায়?”
“তা কেউ জানে না। পরশুদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই সে কোথায় যেন চলে গেছে। তবে হাসপাতালে যে নার্স তার দেখাশোনা করত সে বলেছে কিঙ্কর নাকি বিকারের ঘোরে একটা রাজবাড়ির কথা বলত।”
“তোমরা আর কেউ কিছু জানো না?”
একজন বলে উঠল, “আমি জানি। শঙ্কর ওস্তাদের কাছে মাসখানেক যাবৎ একটা লোক আনাগোনা করছিল। সেই লোকটা যাতায়াত শুরু করার পর থেকেই ওস্তাদের একটা ভাবান্তর লক্ষ করতাম। কেমন যেন গম্ভীর, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একদিন আমাকে ডেকে বলল, ওরে, আমি হঠাৎ মারা পড়লে তোরা কেউ একজনকে একটা খবর দিতে পারবি? আমি বললাম, ‘হঠাৎ মারা যাওয়ার কী হল? ওস্তাদ বলল, কারণ আছে বলেই বলছি। গতিক সুবিধের নয়। আমার পেছনে লোক লেগেছে।”
আর-একটা ছেলে বলে উঠল, “ওস্তাদ আমাকেও একদিন বলেছিল, কারা যেন একটা গুপ্ত খবরের জন্য তাকে ভয় দেখাচ্ছে।”
আগের ছেলেটাকে দুঃখবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “যে-লোকটা যাতায়াত করত তার চেহারা কেমন?”
“লম্বাচওড়া, কালো চেহারা। খুব ভয়ঙ্কর দু’খানা চোখ।”
“নাম জানো?”
“না। তাকে একদিনই দেখেছিলাম। দেখলেই ভয় হয়।”
দুঃখবাবু উঠে পড়লেন। বললেন, “আমাকে নবীগঞ্জে ফিরতে হবে। তোমাদের সঙ্গে মিশে আমার বড় ভাল লাগল।”
“আবার কবে আসবেন?”
“কালই হয়তো আসব। রোজই আসতে পারি।” সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল।
দুঃখবাবু ফেরার পথে দৌড়তে-দৌড়তে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন। মনে ভারী আনন্দ।
মাধব ঘোষাল দুঃখবাবুর সব কথা মন দিয়ে শুনলেন এবং খুশি হয়ে বললেন, “এই তো চাই। তোমাকে কুলাঙ্গার বলে ভাবতাম। এখন দেখছি তুমি মোটেই তা নও।”
দুঃখবাবু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “সবই তো হল ঘোষালমশাই, এখন এই ভুতুড়ে গাঁট্টার একটা বিহিত হওয়া দরকার।”
মাধব ঘোষাল শশব্যস্তে বললেন, “তাড়া কিসের? ওটা চলছে চলুক না। আমি তো লক্ষণ ভালই দেখছি।”
দুঃখবাবু বিদায় নিলে মাধব ঘোষাল ঘটনার টুকরোগুলোকে ফের মনে-মনে সাজাতে শুরু করলেন। জিগ শ পাজলের মতো ভগ্নাংশ জুড়ে ছবিটা যদি পুরো করা যায়।
নিমাই আর নিতাই গোটা নবীগঞ্জ আর আশপাশের গাঁ ঘুরে এসে জানাল, “আমরা বারোজন রাজু পেয়েছি। কিন্তু কারও বিশেষ সোনাদানা নেই। শুধু খিজিরপুরের রাজু ব্যাপারির পয়সা
আছে। তার তামাকের ব্যবসা। বুড়ো মানুষ।”
মাধবের রাজু ব্যাপারিকে পছন্দ হল না। তিনি বললেন, “আরও খোঁজো। অনেকের হয়তো পোশাকি নাম রাজু নয়, ডাকনাম রাজু। এসবও খুঁজে বের করতে হবে।”
“যে আজ্ঞে।” বলে দুই বন্ধু চলে গেল।
মাধব রাজুকে নিয়ে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু কোনও কূলকিনারা পেলেন না। বিকেলের দিকে তিনি ফের রাজবাড়ি রওনা হলেন। কিঙ্করের সঙ্গে আরও কথা হওয়া দরকার।
গিয়ে দেখলেন, কিঙ্কর রাজবাড়ির দোতলার বারান্দায় ডন-বৈঠক করছে। বীরচন্দ্র দাঁড়িয়ে দেখছে।
মাধবকে দেখে বীরচন্দ্র এগিয়ে এসে বলল, “কোনও খবর আছে?”
“ওকে ডন-বৈঠক করাচ্ছ নাকি?”
বীরচন্দ্র হেসে বলল, “কাচ্ছি। মনে হচ্ছে এসব করলে ও স্বাভাবিক থাকবে। ডন-বৈঠক করার অভ্যাস তো?”
“তা বটে। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”
মাধব ঘরে বসলেন। একটু বাদে বীরচন্দ্র ঘর্মাক্ত কিঙ্করকে নিয়ে এল।
সস্নেহে মাধব বললেন, “বোসো কিঙ্কর।” কিঙ্কর বসল।
মাধব তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে বললেন, “লোকটা কালো, লম্বা আর খুব স্বাস্থ্যবান। না?”
কিঙ্কর কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ বাঘের মতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, “কোথায় সে?”
মাধব তাড়াতাড়ি বললেন, “বোসো, বোসো। উত্তেজিত হোয়ো না। সে এখনও এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু চেহারাটা তোমার মনে পড়ছে তো?”
কিঙ্কর ফের বসল এবং ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ ভেবে বলল, “হারিয়ে যাচ্ছে।”
“কী হারিয়ে যাচ্ছে?”
“চেহারাটা।”
“ভাল করে ভাবো। লম্বা, জোয়ান, দুখানা ভয়ঙ্কর চোখ।”
একটু শিউরে উঠে কিঙ্কর বলল, “খুব ভয়ঙ্কর।”
“মনে পড়ছে?”
“চোখ দুখানা ভয়ঙ্কর।”
“আর কিছু?”
“আর বন্দুক। দুম।”
“তার একটা দল আছে না?” কিঙ্কর একটু ভেবে বলল, “আছে।”
“এখন বলো তো, শঙ্কর মারা যাওয়ার আগে তোমাকে কী বলে গিয়েছিল!”
কিঙ্কর একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, “বলেছিল, সাবধান! সাবধান।”
“আর কিছু নয়?”
কিঙ্কর কপালে আঙুল চেপে মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “বলেছিল, সাবধান! সাবধান! নবীগঞ্জে যাও। রা-রাজুকে বোলো ওরা আসছে।”
“রাজুকে তুমি চেনো?”
কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“তুমি তো তোতলা নও, তবে রাজু উচ্চারণ করার সময় রা রাজু বলছ কেন?”
কিঙ্কর চেয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলল না।
বীরচন্দ্র বলল, “জ্যাঠামশাই, আপনি বড্ড উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। এত ভয় পাওয়ার হয়তো কিছুই নেই। শেষ অবধি হয়তো পর্বতের মূষিক প্রসব হবে।”
“তাই যেন হয়। তবে সাবধানের মার নেই। সমস্যা হচ্ছে রাজু। কে এই রাজু তা বুঝতে পারছি না।”