দোকানি মুখোনা তোম্বা করে বলল, “শঙ্কর সেনাপতি! তাকে আর খুঁজে কী হবে? তাকে তো কয়েকটা গুণ্ডা এসে নিকেশ করে গেছে।”
দুঃখবাবু অবাক হয়ে বলেন, “খুন নাকি?”
“খুন বলে খুন? একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেছে। ছেলেটাও মরছিল। তবে বরাতজোরে প্রাণটা রক্ষে হয়েছে। এই তো সবে পরশু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কোথায় চলে গেছে যেন।”
“বাড়িতে আর কেউ নেই?”
“না। বাপব্যাটায় থাকত। কুস্তিটুস্তি করে বেশ নাম হয়েছিল কিঙ্করের। এমনিতে নিরীহ মানুষ ছিল তারা। কেন হামলা হল কেউ জানে না।”
“খুনি ধরা পড়েনি?”
“না মশাই। গভীর রাতে এসে কাজ সেরে পালিয়ে গেছে।”
“তাদের খবর কোথায় পাই বলতে পারেন?”
“খুনির খবর খুঁজছেন?” দুঃখবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “না-না। আমি বাপব্যাটার খবর নিতেই এসেছি।”
“খবর ওইটুকুই।”
দোকানের একটা বেঞ্চে বসে একটা লোক ঘাপটি মেরে কথা শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, “শঙ্করের কাছে একখানা খবর ছিল। সেই খবর চেপে রেখেছিল এতদিন। সেইজন্যই তো বেঘোরে প্রাণটা গেল।”
দুঃখবাবু বললেন, “কিসের খবর?”
“তা অত জানি না। পাঁচজন পাঁচ কথা বলে।”
“সেই কথাগুলো একটু শুনতে পাই?”
“তা পান। তবে এককাপ চা খাওয়াতে হবে।”
দুঃখবাবুর দুঃখের শেষ নেই। বললেন, “খাওয়াব। বলুন।”
“শঙ্কর কোনও এক রাজবাড়িতে মাইনে করা কুস্তিগির ছিল বলে শোনা যায়। তা সেই রাজবাড়ির কোনও গুপ্ত খবর সে জেনে ফেলে। কিসের খবর তা আমি বলতে পারব না। তবে লুকনো খবরই হবে। গুণ্ডাগুলো অনেকদিন ধরেই নাকি তাকে শাসাচ্ছিল।”
“ও বাবা! এ যে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড!”
“খুবই সাঙ্ঘাতিক। চারদিকেই সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড হচ্ছে, আজকাল আর কারও প্রাণের কোনও দাম নেই। চায়ের দামটা দিয়ে দেবেন কিন্তু। আজ চলি। ও হ্যাঁ, ভাল কথা, তা আপনার কোথা থেকে আগমন হচ্ছে?”
“আজ্ঞে নবীগঞ্জ।”
“নবীগঞ্জ? বাঃ, বেশ। নবীগঞ্জ ভাল জায়গা। জলহাওয়া ভাল, ঝুটঝামেলা নেই।”
দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ভাল জায়গা?, ভাল জায়গার নিকুচি করেছে। অতি যাচ্ছেতাই জায়গা মশাই। কাতুকুতু, সুড়সুড়ি, গাঁট্টা, কী নেই সেখানে?”
দোকানির কাছে হদিস জেনে নিয়ে দুঃখবাবু শঙ্কর সেনাপতির বাড়িটাও দেখলেন। গঞ্জের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে একখানা ছোট বাড়ি। সামনের বাগানে একটা কুস্তির আখড়া। বাড়িটা তালা-দেওয়া হলেও আখড়ায় কয়েকজন কুস্তি প্র্যাকটিস করছিল। দুঃখবাবু কুস্তি-টুস্তি পছন্দ করেন না। তবু পায়ে-পায়ে ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়িয়ে কুস্তি দেখতে লাগলেন। কেউ তাঁকে বিশেষ লক্ষ করল না। খানিকক্ষণ কুন্তি দেখার পর জিনিসটা তাঁর বেশ ভাল লাগতে লাগল। উত্তেজনা বোধ করতে লাগলেন। একজন পালোয়ান আর-একজন পালোয়ানকে কাবু করেও সামান্য ভুলের জন্য হারাতে পারছিল না দেখে দুঃখবাবু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে বাঁ পায়ে লেঙ্গি মারুন না। ডান পায়ে ভর দিন, তারপর…”
আশ্চর্যের বিষয়, পালোয়ানটা তাই করল এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিত করে উঠে দাঁড়িয়ে দুঃখবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “আপনি তো ওস্তাদ লোক মশাই! আসুন, ল্যাঙট পরে নিয়ে নেমে পড়ন তো! আমাদের শেখানোর কেউ নেই। শঙ্কর ওস্তাদ খুন হওয়ার পর থেকে আমাদের কিছু হচ্ছে না। আপনি নেমে পড়ন তো!”
দুঃখহরণবাবু সভয়ে তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “পাগল নাকি? আমি তো ফুয়ে উড়ে যাব।”
যারা চারধারে বসে কুস্তি দেখছিল, মাটিমাথা শরীরে সেইসব ছেলে-ছোঁকরা হঠাৎ উঠে হইচই করে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলল। বলল, “আপনি ওস্তাদ লোক, দেখেই বুঝেছি। আপনাকে ছাড়ছি না।”
একরকম জোর করেই তাঁকে তারা ল্যাঙট পরতে বাধ্য করল। দুঃখবাবু কাঁপতে কাঁপতে আখড়ায় নামলেন। কুস্তির ক-ও তিনি
জানেন না। কিন্তু উপায় কী? মাধব ঘোষালের পাল্লায় পড়ে বেঘোরে না প্রাণটা যায়!
কুস্তি করতে এল নিতান্ত ছোঁকরা এক কুস্তিগির। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। তার দুখানা হাত যেন সাঁড়াশির মতো এসে জাপটে ধরল দুঃখবাবুকে। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। তবে আত্মরক্ষার তাগিদে আঁকুপাঁকুও করতে লাগলেন। হঠাৎ মাথায় খটাং করে একটা গাঁট্টা এসে লাগল। কে যেন কানে কানে বলল, “বাঁ হাতটা তুলে ওর ঘাড়টা ধর। অন্য হাত দিয়ে থুতনির তলায় চেপে উলটে দে।”
দুঃখবাবু তাই করলেন। এবং ছেলেটা পটাং করে তাঁকে ছেড়ে উলটে পড়ে গেল। চারদিকে সপ্রশংস হর্ষধ্বনি উঠল, “হ্যাঁ, ওস্তাদ বটে।”
দুঃখবাবু হাঁফাতে-হাঁফাতে পালানোর পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু। পালাবেন কি! সবাই একেবারে ঘিরে ধরেছে তাঁকে।
পালানোর উপায় নেই। ফলে আবার একজনের সঙ্গে কুস্তি করতে হল দুঃখবাবুকে। এবার কেউ কানে কানে প্যাঁচ মারার কায়দা শেখাল না। দুঃখবাবু নিজেই একটা প্যাঁচ আবিষ্কার করে দ্বিতীয় জনকেও হারিয়ে দিয়ে খুবই অবাক হয়ে গেলেন।
চারদিকে একটা হইহই পড়ে গেল। দুঃখবাবু আর তেমন দুঃখ-দুঃখ ভাবটা টের পাচ্ছিলেন না। আজ তাঁর ঘাড়ে একটা কিছুর ভর হয়ে থাকবে। তিনি তিন নম্বর লড়াইতেও ভালই লড়লেন এবং জিতে গেলেন। অথচ এই কুস্তিগিরদের হাতে তাঁর মারা যাওয়ার কথা।
কুস্তির আসরটা একসময়ে শেষ হল। দুঃখবাবুকে মাঝখানে রেখে সবাই ঘিরে বসল তাঁকে। একজন বলল, “এতদিন কোথায় ছিলেন ওস্তাদ? আপনাকে পেলে আমাদের আর শঙ্কর ওস্তাদের কথা মনেই থাকবে না।”