মাধব বললেন, “কিছু বুঝতে পারছ বিরু?”
“আজ্ঞে না জ্যাঠামশাই। হয়তো আবোল-তাবোল।”
“একটা ষড়যন্ত্রের আভাস বলে মনে হচ্ছে না?”
বীরচন্দ্র একটু হাসল, বলল, “আপনি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? কিঙ্করের বুদ্ধি স্থির নেই। স্মৃতিশক্তিও কাজ করছে না। বিচ্ছিন্ন কথা থেকে কিছু তো বোঝার উপায় নেই।”
মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বিচ্ছিন্ন কথাগুলোকে জোড়া দিলে কিন্তু একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। একটা পাজি লোক শঙ্করকে খুন করেছে, কিঙ্করকে জখম করেছে। তারপর এখানে রাজু নামে কাউকে খুন করতে আসছে। রাজুর কাছে হয়তো সোনাদানাও আছে।”
বীরচন্দ্র গম্ভীর হয়ে বলল, “সেটা অসম্ভব নয়। তবে গাঁয়ে তো রাজু নামে কেউ নেই বলছেন।”
মাধব বললেন, “আমার চেনাজানার মধ্যে হয়তো নেই। ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে।”
মাধব কিঙ্করের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা কিঙ্কর, তুমি কী কী খেতে ভালবাসো?”
কিঙ্কর এই প্রশ্নটা শুনে যেন খুশি হল। বলল, “লাল চেঁকিছাঁটা চালের ভাত, ঘন মুগ ডাল, খাসির মাংস, পায়েস আর রসগোল্লা।”
মাধব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কখনও কখনও স্মৃতি বেশ কাজ করছে দেখছি। আচ্ছা, কিঙ্কর, কোন দোকানের রসগোল্লা সবচেয়ে ভাল?”
“চারু ময়রা।”
“চারু ময়রার দোকানটা কোথায়?”
“কেন, বাজারে।”
“কোথাকার বাজার?”
“রসুলপুর।”
মাধব বীরচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রসুলপুর খুব একটা দূরে নয়। সেখানে আমার যজমান আছে। আজ বিকেলেই খবর পেয়ে যাব। মনে হচ্ছে ঘটনার সূত্র সেখানেই পাওয়া যাবে।”
মাধব উঠে পড়লেন। মুখে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ। বাড়ি ফেরার পথে তিনি দুটো কাজ করলেন। নিমাই আর নিতাইকে পাঠালেন, গাঁয়ে রাজু নামে কেউ আছে কিনা তা ভাল করে খুঁজে দেখতে। দ্বিতীয় কাজটা দুঃখহরণের সঙ্গে একটা গোপন সাক্ষাৎকার।
মাধবের প্রস্তাব শুনে দুঃখবাবু একটু আঁতকে উঠে বললেন, “বারো মাইল! ও বাবা, বারো মাইল দৌড়লে আমি মরেই যাব।”
মাধব প্রশান্ত মুখে বললেন, “ভূতের গাঁট্টা খেয়ে তোমার অনেক উন্নতি হয়েছে দুঃখহরণ। কিন্তু সেটা তুমি বুঝতে পারছ
। বারো মাইল কিছুই না। এ-বেলা রসুলপুরে যাওয়ার কোনও গাড়ি নেই। এখন তুমিই ভরসা। খবরটা জরুরি কিনা।”
দুঃখবাবু দুঃখিতভাবে বললেন, “আমি রোগা, দুর্বল মানুষ। আমার ওপর অনেক অত্যাচারও হচ্ছে। কাতুকুতু, সুড়সুড়ি, গাঁট্টা, কিছু আর বাকি নেই। এর ওপর আপনি বারো মাইল দৌড় করালে আমি কি আর বাঁচব?”
“খুব বাঁচবে। তুমি রোগা আর দুর্বল ছিলে বটে, কিন্তু এখন তোমার হাত-পা সবল হয়েছে, ফুসফুঁসের ক্ষমতা বেড়েছে, তুমি সেটা পরীক্ষা করে দ্যাখো। মনে রেখো, তুমিও একজন কুস্তিগিরের বংশধর। কুলাঙ্গার হওয়া কি ভাল?”
দুঃখবাবু রাজি হচ্ছিলেন না, বললেন, “ও আমি পারব না মশাই। আপনি অন্য লোক দেখুন।”
বলেই হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠলেন দুঃখবাবু, “ওঃ, এখন আবার গাঁট্টা পড়ছে কেন? এ-সময়ে তো গাঁট্টা পড়ার কথা নয়। সকালে যে চার-পাঁচ মাইল দৌড়ে এলাম। উঃ, ওই আবার।”
মাধব গম্ভীর মুখে দুঃখবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “তা হলে তুমি যাবে না?”
দুঃখবাবু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি! না গিয়ে উপায় আছে? যা দুখানা গাঁট্টা ঝেড়েছে যে, মাথা ঝিমঝিম
করছে। তা কিসের খবর আনতে হবে? তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সময় নেই।”
মাধব বললেন, “রসুলপুরে শঙ্কর সেনাপতির খোঁজ কোরো। তার একটা ছেলে আছে, নাম কিঙ্কর, তাদের সব খবর আমার চাই। তাদের সম্পর্কে কোনও গুজব থাকলে তাও শুনে এসো।”
দুঃবাবু দৌড় শুরু করে দৌড়তে-দৌড়তেই বললেন, “ঠিক আছে মশাই, ঠিক আছে। আমার আর দাঁড়ানোর উপায় নেই। শিলাবৃষ্টির মতো গাঁট্টা পড়তে লেগেছে।”
মুহূর্তের মধ্যে দুঃখবাবু হাওয়া হয়ে গেলেন। মাধব বাড়ি ফিরে বাগানে একটা গাছের ছায়ায় বসে গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগলেন। শঙ্কর সেনাপতিকে তিনি চিনতেন। খুবই ডাকাবুকো লোক। রাজা পূর্ণচন্দ্রের আমলেই রাজবাড়ির সুদিন শেষ হয়ে যায়। সরকারের ঘরে বিস্তর দেনা জমে গিয়েছিল। সেসব মেটাতে গিয়ে পূর্ণচন্দ্র সর্বান্ত হন। পোষ্যদের বিদায় করে দিতে হয়। দাসদাসীদের বেতন দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর আর ছিল না। রাজবাড়ি সংকারের অভাবে ভেঙে পড়ছিল, তা সারানোর ক্ষমতাও তাঁর তখন নেই। বসতবাড়ি আর সামান্য দেবত্র সম্পত্তি ছাড়া সবই ক্রোক হয়ে যাওয়ার পর রাজবাড়ি একেবারে ভূতের বাড়ির মতো হয়ে গেল। পূর্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর নাবালক বীরচন্দ্রকে ঠকিয়ে আমলা কর্মচারী এবং আত্মীয়রা অস্থাবর যা কিছু ছিল সব হাত করে নেয়। সেটা তো ইতিহাস। কিন্তু শঙ্কর সেনাপতির কী হল তা মাধব জানেন না। রাজুটাই বা কে? কিঙ্করের অসংলগ্ন কথাবাতাকেই বা কতখানি গুরুত্ব দেওয়া উচিত? কিঙ্কর যদি পাগল হত, তা হলে মাধব গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু কিঙ্কর পাগল নয়, স্মৃতিভ্রষ্ট মাত্র। তা ছাড়া শঙ্কর সেনাপতির ছেলে। মাধবের মনটা কুডাক ডাকছে।
দুঃখবাবু দৌড়ে যখন রসুলপুর পৌঁছলেন তখন বেলা সাড়ে দশটার বেশি হয়নি। তিনি হাঁফিয়ে পড়লেও নেতিয়ে পড়েননি। ধুতির খুঁটে ঘাড়-গলার ঘাম মুছে একটু জিরিয়ে নিলেন। গাঁট্টা বন্ধ হয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে। রসুলপুর বড় একখানা গঞ্জ। মেলা দোকানপাট, বাড়িঘর, বহু মানুষের বাস। বাজারটাও বেশ বড়। চারু ময়রার মিষ্টির দোকানে বসে দুঃখবাবু গোটাদশেক গরম বড়বড় রসগোল্লা খেলেন। তারপর দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ মশাই, এখানে শঙ্কর সেনাপতির বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারেন?”