“আপাতত আমার কাছেই রেখে দেব, মুশকিল হচ্ছে, ছেলেটা মাঝে-মাঝে খুব চঞ্চল হয়ে উঠছে। একটা কিছু বোঝাতে চাইছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। ও ঘুমিয়ে পড়ার ফলে রাতে আমি ওর মাথাটা দেখেছি। সন্দেহ ছিল মাথার চোট থেকেই স্মৃতিভ্রংশ হয়ে থাকতে পারে। মাথার পেছন দিকটায় দেখলাম, মস্ত বড় একটা ক্ষতচিহ্ন শুকিয়ে আছে। দেখে বোঝা যায়, খুব বেশিদিন আগেকার চোট নয়, সম্প্রতিই হয়েছে।”
মাধব মাথা নেড়ে বললেন, “বুঝেছি। ওর কাছ থেকে আরও কিছু কথা বের করতে হবে। আমি একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।”
“সেটা আমিও পাচ্ছি। কিন্তু কীরকম বিপদ হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
মাধব একটু ভেবে বললেন, “বিপদ অনেক রকমেরই হতে পারে। এই তোমার কথাই ধরো। তুমি রাজবংশের ছেলে। রাজাগজাদের ওপর অনেকের রাগ থাকে।”
বীরচন্দ্র একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “সতর্ক থাকতে বলছেন?”
“থাকা ভাল। তোমার অস্ত্রশস্ত্র কী আছে?”
“কিছুই প্রায় নেই। বন্দুক, পিস্তল যা ছিল সব সরকারকে দিয়ে দিয়েছি। দু’খানা ভাল দোধারওলা বিলিতি তলোয়ার আছে। আর সামান্য কয়েকটা ছোরাছুরি।”
“তলোয়ার চালাতে পারো?”
“আগে পারতাম। এখন ভুলে গেছি।”
“যা জানো তাতেই হবে। তোমার রক্তেই শিক্ষাটা আছে। চিন্তা কোরো না।”
বীরচন্দ্র একটু হেসে বলল, “আমি নিজের জন্য কখনওই চিন্তা করি না। অযথা ভয়ও পাই না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন সতর্ক থাকব।”
“আমি লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকলে।”
“আপত্তি কিসের? আপনি বিচক্ষণ মানুষ, হয়তো ওর কথার সূত্র ধরে কিছু অনুমান করতে পারবেন। ও যে শঙ্কর সেনাপতির ছেলে, এটা তো আমি আবিষ্কার করতে পারিনি, আপনি বসুন, আমি ওকে ডেকে আনছি।”
বীরচন্দ্র উঠে গেল এবং কিছুক্ষণ পর তার পিছু পিছু প্রকাণ্ড চেহারার কিঙ্কর এসে ঘরে ঢুকে দাঁড়াল। মাধব ঘোষাল তার আপাদমস্তক ভাল করে লক্ষ করলেন। হ্যাঁ, এ কুস্তিগিরই বটে। কিন্তু ছোট-ঘোট দুখানা চোখে বুদ্ধির দীপ্তি নেই। কেমন একটা অস্থির, উদ্বেগাকুল চাউনি।”
মাধব হাসিমুখে বললেন, “বোসো কিঙ্কর।” কিঙ্কর একখানা চেয়ারে বাধ্য ছেলের মতো বসল, একটু জড়োসড়ো ভাব। দিনের আলোতে লোকটাকে এত নিরীহ লাগছিল যে, এই লোকটাই কাল রাতে গাঁয়ে দৌরাত্ম্য করে বেড়িয়েছে সেটা বিশ্বাস হয় না।
মাধব তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখ রেখেই বললেন, “নবীগঞ্জে তুমি আগে কখনও এসেছ?”
কিঙ্কর একটু হতবুদ্ধির মতো বসে থেকে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“একসময়ে তোমার বাবা শঙ্কর সেনাপতি কিন্তু এখানে থাকত। এই রাজবাড়িতেই হাতিশালের পেছনে তার ঘর ছিল। জানো?”
কিঙ্করের চোখে কি একটু স্মৃতির ঝলকানি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল? একটা ঢোক গিয়ে সে বলল, “কিন্তু লোকটা কোথায়?”
“তুমি কি একটা বজ্জাত লোককে খুঁজছ?”
কিঙ্কর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দু হাত মুঠো পাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তাকে পেলে আমি…”
মাধব হাসলেন, “উত্তেজিত হোয়ো না। সে হয়তো এখনও নবীগঞ্জে এসে পৌঁছয়নি। এখন বলল তো, লোকটা কেন নবীগঞ্জে আসছে?”
কিঙ্কর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, “মারবে। কিন্তু তাকে আমি…”
মাধব বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “কাকে মারবে?” কিঙ্কর আবার ঠাণ্ডা হয়ে মাথা চুলকে একটু ভাবল। তারপর বলল, “একজনকে মারবে।”
“তোমাকে কি তার জন্যই এখানে পাঠানো হয়েছে? কে পাঠাল তোমাকে?”
কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “বাবা।”
“তোমার বাবা শঙ্কর? সে এখন কোথায়?” কিঙ্কর সজোরে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “নেই। মেরে ফেলেছে। বন্দুক দিয়ে।”
“বন্দুক দিয়ে?”
“দুম করে, ওঃ, কী শব্দ!” বলে যেন সভয়ে একবার চারদিকে চেয়ে দেখে নিল কিঙ্কর।
মাধব বললেন, “আমাদের বন্দুক নেই। ভয় পেও না।”
“ওই লোকটার আছে। দুমদুম করে শব্দ হয়। বন্দুক খুব খারাপ জিনিস।”
“তোমাকে লোকটা কী দিয়ে মারল?”
“বন্দুক দিয়ে।” বলে কিঙ্কর একবার ডান হাতটা তুলে মাথার পেছন দিককার ক্ষতস্থানটিতে হাত বুলিয়ে নিল।
মাধব আর বীরচন্দ্র নিজেদের মধ্যে একটু দৃষ্টিবিনিময় করে নিলেন। মাধব মৃদুস্বরে বললেন, “বজ্জাত লোকটা এখানে কাকে মারতে আসবে?”
“একজনকে।”
“কয়েকটা নাম বলছি। মনে করে দ্যাখো তো, এদের মধ্যে কেউ কি না। মাধব ঘোষাল, সত্যেন রায়, পুঁটে সর্দার, হরিহর পণ্ডিত, বীরচন্দ্র রায়চৌধুরী। এদের মধ্যে কেউ?”
কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলল, “এরা নয়। অন্য লোক।”
“নামটা মনে নেই বুঝি?”
“রা রাজু।”
মাধব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “রাজু! এখানে রাজু নামে আবার কে আছে? আমার নাতির নাম রাজু বটে, কিন্তু সে তো বাচ্চা ছেলে।”
কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “আমার খিদে পাচ্ছে।”
বীরচন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠে গেল এবং একটু বাদেই বনমালী একখানা গামলার সাইজের রাজকীয় কাঁসার বাটিতে বিপুল পরিমাণে চিড়ে-দই আর সন্দেশের ফলার নিয়ে এল।
কিঙ্কর যে খেতে খুবই ভালবাসে, সেটা তার খাওয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল। গপাগপ করে তিন মিনিটে বাকিটা শেষ করে সে একঘটি জল খেয়ে হঠাৎ বলল, “সোনা।”
মাধব একটু ঝুঁকে পড়লেন, “কিসের সোনা? কোথায় সোনা?”
“আছে। লোকটা জানে।”
মাধব একবার বীরচন্দ্রের দিকে তাকালেন। বীরচন্দ্রের মুখে কোনও ভাবান্তর নেই।