একটু ঘুরপথে লোকের চোখ এড়িয়ে মাধব এসে রাজবাড়িতে ঢুকলেন।
ভুজঙ্গ হালদার আজও বাজারে যাচ্ছিলেন। মাধবকে দেখে তটস্থ হয়ে বললেন, “পরেশ ভটচাজমশাই যে! ভাল আছেন তো!”
মাধব ঘোষাল একটু হেসে বললেন, “ভালই আছি হে ভুজঙ্গ। তা তোমাদের খবরটবর কী?”
ভুজঙ্গ ঠোঁট উলটে বললেন, “খবর আর কি? সেই থোড়বড়ি-খাড়া। ডাল-চচ্চড়ি খেয়ে কোনওরকমে বেঁচে থাকা। আজ আবার যজ্ঞিবাড়ির বাজারের হুকুম হয়েছে। কে জানে বাবা কারা খাবে। তা রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন নাকি নগেনবাবু? যান ওপরে চলে যান।”
মাধব ঘোষাল বুঝলেন, তাঁর অনুমানই ঠিক। এখানেই আছে। নইলে মোটা বাজারের হুকুম হত না। চারদিকটা চেয়ে দেখলেন মাধব। একসময়ে রাজবাড়িটা ছিল বিশাল। এখন সামনের মহলটা ভেঙে পড়ে ভগ্নস্তূপ হয়ে আছে। অন্দরমহলের অনেকটাই ভাঙাচোরা। আগে এই রাজবাড়ির কত জাঁকজমক ছিল। হাতিশাল, আস্তাবল, গোয়াল। সেপাই-সান্ত্রি, দাস-দাসী। নহবতখানা থেকে রোজ সকালে শিঙা বাজত। তার এখন কিছুই নেই। বীরচন্দ্র খুবই কায়ক্লেশে থাকে। ভাল করে খাওয়া জোটে না, নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই বলে ছেঁড়া-ময়লা পরে থাকে। বীরচন্দ্র মাধবকে কয়েকবারই বলেছে, আমার যদি টাকা থাকত তা হলে বাবুগিরি না করে আমি এই নবীগঞ্জের উন্নতি করতাম।
মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহল্লায় গিয়ে ঢুকলেন। তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন।
দোতলার বিশাল বৈঠকখানায় বীরচন্দ্র একা বসে বিষমুখে কী যেন ভাবছিল। মাধবকে দেখে তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল, “আসুন জ্যাঠামশাই।”
মাধব স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করে বললেন, “তোমার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এলাম। কাল রাতে কি কোনও ঘটনা ঘটেছে? সারা গাঁয়ে তো হুলুস্থুল পড়ে গেছে, গাঁয়ে নাকি একটা রাক্ষস বা দানো বা ভূত কিছু একটা ঢুকেছে। অনেকেই দেখেছে তাকে।”
বীরচন্দ্র একটু হাসল। বলল, “সবাই খুব ভয় পেয়েছে বুঝি?”
“ভীষণ, সারা গাঁয়ে এখন ওই একটাই আলোচনা।”
বীরচন্দ্র ফের বিষণ্ণ হয়ে বলল, “ভয় পেলে লোকে ভুল দেখে। ভাল করে লক্ষ করলে বুঝতে পারত, লোকটা দৈত্য, দানো, অপদেবতা কিছুই নয়, তবে খুব বড়সড় চেহারার একজন মানুষ!”
“সে কি তোমার কাছে আছে এখন?”
বীরচন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “আছে। তাকে আমি লুকিয়ে রেখেছি।”
“তোমার দুর্জয় সাহস। লোকটা কেমন না জেনে আশ্রয় দেওয়া কি ঠিক হয়েছে বিরু?”
বীরচন্দ্র বিষণ্ণমুখে বলল, “লোকটা পাগলাটে ধরনের হলেও বোধ হয় বিপজ্জনক নয়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। আমি আশ্রয় না দিলে আজ সকালে নবীগঞ্জের লোকেরা ওকে হয়তো রাক্ষস বা দৈত্য মনে করে সবাই মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলত। লোকে ভয় পেলে তো আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।”
মাধব একটু চিন্তা করে বললেন, “বোধ হয় তুমি বিচক্ষণের মতোই কাজ করেছ। লোকটার পরিচয় কিছু জানতে পারলে? কী চায় ও?”
বীরচন্দ্র চিন্তিত মুখে বলল, “ও একজন লোককে খুঁজছে। কিন্তু সে যে কে, তা ঠিকঠাক বলতে পারছে না। চেহারার বিবরণ এক-একবার এক-একরকম দেয়, নামও নানারকম বলছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, লোকটার ওপর ওর খুব রাগ। ওর ধারণা, লোকটা নবীগঞ্জে এসেছে বা শিগগিরই আসবে। আমি সেইজন্যই একটু চিন্তিত জ্যাঠামশাই।”
“কেন বলো তো! চিন্তার কী আছে?”
“ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, যার সন্ধানে ও এসেছে সেই লোকটা খুবই খারাপ ধরনের। একটা কোনও মতলব হাসিল করতে এসেছে। সেই লোকটা বোধ হয় এরও কোনও ক্ষতি করেছিল কখনও। কিন্তু কী ক্ষতি করেছিল তা বলতে পারছে না। ওর মনে নেই। শুধু মনে আছে, ক্ষতি একটা করেছিল।”
“নামধাম কিছু জানতে পারলে? কেমন লোক এ?”
“নাম বলছে কিঙ্কর। চেহারা দেখে মনে হয়, কুস্তিটুস্তি করত। গায়ে খুব জোরও আছে। সম্ভবত মাথায় চোট পেয়ে স্মৃতি নাশ হয়েছে।”
“কিঙ্কর নাম? পদবি কী?”
“কিঙ্কর সেনাপতি।”
মাধবের ভ্রূ কুঁচকে গেল, “সেনাপতি! আশ্চর্যের বিষয়, তোমার বাবা পূর্ণচন্দ্রের দরবারে একজন কুস্তিগির ছিল, তার নাম শঙ্কর সেনাপতি। তারও বিশাল চেহারা ছিল, নামডাকও ছিল খুব। এই কিঙ্কর সেই শঙ্করের কেউ হয় না তো?
বীরচন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, “তা তো জানি না।”
“লোকটা কোথায়?”
“চলুন, ওই কোণের দিকের একটা ঘরে ঘুমোচ্ছে।” বীরচন্দ্র মাধবকে দোতলার শেষপ্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে এল। ভেজানো দরজা ঠেলে দুজনে ভেতরে ঢুকলেন।
রাজবাড়ির সব জিনিসই আকারে বেশ বড়। এই কোণের ঘরটায় খাট-পালঙ্ক না থাকলেও বিশাল একখানা চৌকি আছে। অতি মজবুত শালকাঠে তৈরি। তার ওপর শতরঞ্চিতে শুয়ে বিশাল চেহারার লোকটা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। গায়ে হাতকাটা
গেঞ্জি আর পরনে পাজামা। বোধ হয় বিরুর দেওয়া।
মাধব তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “মনে হচ্ছে এ শঙ্করেরই ছেলে। চেহারার আদল একই রকম।”
দু’জনে ফের বৈঠকখানায় ফিরে এসে মুখোমুখি বসলেন।
মাধব বললেন, “ওকে দেখে গাঁয়ের লোক এত ভয় পেল কেন, তা বুঝলাম না। চেহারাটা বিরাট ঠিকই, কিন্তু বিকট তো নয়।”
“কিঙ্করের পোশাক তো আপনি দেখেননি, ও পরে ছিল কালো সার্টিনের ওপর জরির কাজ করা পোশাক। অনেকটা রাজাটাজাদের মতো। তাইতেই লোকে ভড়কে গিয়ে থাকবে।”
মাধব গম্ভীর মুখে বললেন, “হু, অন্ধকার রাত্রি, জরির পোশাক এবং বিরাট চেহারা। সব মিলিয়েই কাণ্ডটা ঘটেছে। এখন একে নিয়ে তুমি কী করবে?”।