সে লোকটার দিকে চেয়েই বুঝতে পারল, লোকটা দেখতে যত ভয়ঙ্কর আসলে তত বিপজ্জনক নয়।
সে মৃদু হেসে বলল, “এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ থাকে। আপনি কাকে খুঁজছেন?”
“আরে ওই যে সিঁড়িঙ্গে চেহারার লম্বা বেঁটেপানা লোকটা! একমাথা টাক, তার ওপর বাহারে টেরিকাটা বাবরি। গায়ের রং কালো হলে কী হবে, টকটক করছে ফরসা।”
বীরচন্দ্র দরজা ছেড়ে দিয়ে বলল, “আসুন ভেতরে।”
৩. নবীগঞ্জে হইচই
ভোর হতে-না-হতেই নবীগঞ্জে হইচই পড়ে গেল। কেউ বলে ভূত, কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে রাক্ষস, কেউ বলে যমদূত। মাধব ঘোষাল গাঁয়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ মানুষ, সবাই তাঁকে গাঁয়ের মাতব্বর বলে মানে।
ভোরবেলা নবীগঞ্জের লোক এসে সব জড়ো হল মাধব ঘোষালের বৈঠকখানায়। যারা দেখেছে তারাও, যারা শুনেছে তারাও।
হারু ভটচাজ বলল, “নবীগঞ্জে অভাব-অভিযোগ মেলা আছে বটে, কিন্তু রাক্ষসের উৎপাত কোনওকালে ছিল না। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির যুগে রাক্ষসটা এল কোত্থেকে তাই ভাবছি। এ তো বড় চিন্তার কথা হল ঘোষালমশাই।”
ভজনলাল বলে উঠল, “উ তো সবাইকে খেয়ে লিবে। হামাকেই খেয়ে বিচ্ছিল। তো হামি হাতজোড় করে বললাম, ‘রাক্ষসজি, একটু বইসুন, আমি থোড়া ডাল-রোটি খেয়ে লেই, তারপর যদি আপনি আমাকে খান তো খেতে মিষ্টি লাগবে।”
পাঁচু একটু পেছনে ছিল। সে বলল, “রাক্ষস-টাক্ষস নয়, আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। ঘোষালজ্যাঠা, আমার মনে হয় এ হল বিভীষণ। বিভীষণের তো মৃত্যু নেই। কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল এতদিন। হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। তবে কাকে যেন খুঁজছিল। ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
ভজনলাল বলল, “ও বাত ঠিক। রাক্ষসজি কাউকে টুড়ছে।”
হঠাৎ রাস্তা দিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে এসে দুঃখবাবু ভিড় ঠেলে ঢুকলেন। হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, “একটা কথা টক করে বলে দিয়ে যাই ঘোষালমশাই, ভূতটা কাতুকুতু পছন্দ করে না। একটা বেঁটে, মোটা, লম্বা, রোগা, ফরসা আর কালো লোককে খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুবই জটিল ব্যাপার। কিন্তু আমার আর দাঁড়ানোর সময় নেই! উঃ…ওই আবার গাঁট্টা পড়ল। যাই…।”
সকাল থেকে কান ফের বন্ধ হয়ে গেছে পুঁটে সর্দারের। লোকের মুখ দেখে বক্তব্য অনুমান করার চেষ্টা করতে করতে সে বলল, “যমদূত বাবাজিকে কাল রাতে এমন ঠকান ঠকিয়েছি যে, আর বলার নয়। ধরে নিয়ে যাচ্ছিল আর কি! মুখে-মুখে হিসেব কষে দেখিয়ে দিলাম যে, আমার মরার বয়সই হয়নি। তখন আর রা কাড়ে না। মিনমিন করে বলল, ‘যাই হোক একটা ধরে নিয়ে যেতেই হবে, নইলে যমরাজা রেগে যাবেন। কিন্তু কাকে যে নিয়ে গেল, বুঝতে পারছি না! সকালে উঠে সারা নবীগঞ্জে টহল দিয়ে দেখলাম, সবাই দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে।”
হরিহর পণ্ডিত মাথার ঘাম মুছে বলল, “খুব ফাঁড়াটা গেছে রাত্তিরে। গাছে উঠে বসে আছি, তাতেও নিস্তার নেই। গাছ ধরে এমন ঝাঁকাচ্ছিল যে, পাকা আমটির মতো আমার খসে পড়ার কথা। গায়ত্রী জপ করতে থাকায় পড়িনি।”
নয়ন বোস একটা আংটি অদৃশ্য করে হাতের তেলোয় একটা বলের আবির্ভাব ঘটিয়ে বলল, “আমার জানলার শিক তো বেঁকিয়েই ফেলেছিল প্রায়। আমি তাকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ব্যাটা খুব চালাক। আমার চোখে ভয়ে চোখই রাখছিল না।”
হাবু ঘোষ একটু খেচিয়ে উঠে বলল, “আর কেরানি দেখিও না। তাকে দেখে তো মূর্ছা গিয়েছিলে।”
নয়ন গম্ভীর হয়ে বলল, “আপনি ওসব বুঝবেন না। হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করেও যদি না পারা যায় তা হলে সেটা নিজের ওপরেই বর্তায়। ওকে বলে হিপনোটিক ব্যাকল্যাশ। সোজা কথা, আমি নিজের হিপনোটিজমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।”
হাবু ঘোষ গরম হয়ে বলল, “দ্যাখো, কথায় কথায় ইংরেজিতে গালমন্দ কোরো না। রাসকেল, ইডিয়ট বলল ঠিক আছে। সে তবু সওয়া যায়। কিন্তু ওই ব্যাকল্যাশ-ট্যাকল্যাশ খুব খারাপ কথা।”
ইতিমধ্যে ভিড় দেখে হরিদাস চিনেবাদাম ফিরি করতে চলে এসেছে। পঞ্চানন চায়ের কেটলি আর ভাঁড় নিয়ে এসে চা বিক্রি করতে লেগেছে। বাউল চরণদাস গান গেয়ে ভিক্ষে চাইছে।
মাধব ঘোষাল খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এত মানুষ যখন তাকে দেখেছে তখন ঘটনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু লোকটা গেল কোথায়? ভাল করে খোঁজা হয়েছে?”
সবাই প্রায় সমস্বরে জানাল যে, সারা গাঁ আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মাধব ঘোষাল চিন্তিত মুখে বললেন, “আপনারা সবাই বাড়ি যান। রাতে সবাই মিলে পালা করে গাঁ পাহারা দিতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, রাক্ষস, খোকস, দৈত্য, দানো যেই হোক, ক্ষতি করার হলে কাল রাতেই করত। তা যখন করেনি তখন ভয় পাওয়ার দরকার নেই। একটু সাবধান থাকলেই হবে।”
ধীরে-ধীরে সবাই চলে গেল। কিন্তু মাধব ঘোষালের কপাল থেকে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো মুছল না। তিনি উঠে ধুতি-জামা পরলেন। তারপর খিড়কির দরজা দিয়ে বেরোলেন।
মাধব ঘোষাল জানেন, গাঁয়ের লোক সব জায়গায় খুঁজলেও একটা জায়গায় খোঁজেনি, সেই জায়গাটার কথা কারও মাথাতেও আসবে না। সেটা হল রাজবাড়ি।
আর কেউ না গেলেও রাজবাড়িতে মাধব ঘোষালের যাতায়াত আছে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা রাজবাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন। এখন সেই প্রথা উঠে গেলেও সম্পর্কটা বজায় আছে। মাধব বীরচন্দ্রকে খুবই স্নেহ করেন। বীরচন্দ্রের অনেক গুণ, কিন্তু মুখচোরা আর লাজুক বলে জীবনে তেমন কিছুই করতে পারেনি, শুধু বীণা বাজায়। মাধবের ভয় হচ্ছিল, দৈত্য বা দানো যেই হোক সে বীরচন্দ্রের কোনও ক্ষতি করেনি তো!