- বইয়ের নামঃ নবীগঞ্জের দৈত্য
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. শরৎকালের সকাল
নবীগঞ্জের দৈত্য – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শরৎকালের সকাল। চারদিকে বেশ নরম রোদ। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। প্রজাপতি উড়ছে। গোরুর হাম্বা শোনা যাচ্ছে। হরিহরের পাঠশালায় ছেলেরা নামতা মুখস্থ করছে। মহিমের পিসি উঠোনের কোণে ভাত ছড়িয়ে কাকদের ডাকাডাকি করছে। পাঁচু চোর সারারাত চুরির চেষ্টা করে বাড়ি ফিরে পান্তাভাত খেতে বসেছে। রায়বাবু রুপোবাঁধানো লাঠি হাতে প্রাতভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে কুকুর। হাড়কেপ্পন হাবু বিশ্বাস খালের জলে গামছা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। নিমাই আর নিতাই দুই বন্ধু পুকুরের ধারে বসে দাঁতন করতে করতে সুখ-দুঃখের গল্প করছে। শিকারি বাসব দত্ত তার দাওয়ায় বসে পুরনো বন্দুকটায় তেল লাগাচ্ছে। জাদুকর নয়ন বোস বাইরের ঘরে বসে পামিং-পাসিং প্র্যাকটিস করছে। হরেন চৌধুরী ওস্তাদি গানের কালোয়াতি করে যাচ্ছে। আর বটতলায় হলধরের কাছে বসে ন্যাড়া হচ্ছে পুঁটে সর্দার।
পুঁটে বলল, “দিনকাল কী পড়ল রে হলধর। আলুর কেজি আশি পয়সা! চাল আড়াই টাকা কিলো!”
হলধর পুঁটের মাথা কামাতে-কামাতে বলল, “আমার ছোট ছেলেটার কথা বলছ তো! না, তার এখনও কোনও হিল্লে হল না।”
“তাই তো বলছি রে! যুদ্ধের সময় আকাল পড়েছিল, আর এই এইবারই দেখছি।”
“তা যা বলেছ। আজকালকার ছেলে-ছোঁকরারা কি আর মা-বাপের কথা শুনে চলে? আমার মেজো শালার মস্ত পাটের ব্যবসা, কতবার বলি, ওরে একবার মামার কাছে যা। না, তার নাকি সম্মানে লাগে।”
“একেবারে নিয্যস কথাটা বলেছিস কিন্তু। রামভজন দুধওলার দুধে আর সর পড়ে না। ঘি, তেল, কোনটা খাঁটি আছে বল?”
কথাটা হল, পুঁটে সর্দারের বয়স নব্বই ছাড়িয়েছে, হলধরের পঁচাশি, দু’জনেই শক্তসমর্থ আছে বটে, কিন্তু কেউই কানে শোনে না। এ একরকম বলে, ও আর-একরকম শোনে। তবু দু’জনেই সমানে কথাবার্তা চালিয়ে যায়। গত পঞ্চাশ বছর ধরে চালিয়ে আসছে। পুঁটে সর্দার প্রতি মাসে একবার করে ন্যাড়া হয়, আর হপ্তায় দু’দিন দাড়ি কাটে। সবই হলধরের কাছে।
প্রতি মাসে ন্যাড়া হওয়ার পেছনে একটা বৃত্তান্ত আছে। পুঁটে সর্দার যৌবনকালে মস্ত ডাকাত ছিল! এই নবীগঞ্জের পশ্চিমে নদীর ওধারে যে পেল্লায় জঙ্গল ছিল, সেখানেই ছিল তার আচ্ছা। আশপাশে গাঁয়ে-গঞ্জে তার অত্যাচারে কেউ আর টাকাপয়সা ঘরে রাখতে পারত না। ডাকসাইটে সাহেব-দারোগা অবধি তাকে কখনও ধরতে পারেনি। তবে নবীগঞ্জের রাজা ক্ষেত্রমোহন চৌধুরীকে সে একটু এড়িয়ে চলত। ক্ষেত্র চৌধুরীর একখানা ছোটখাটো ফৌজ ছিল। তাদের বিক্রমও ছিল খুব। সাহেব-দারোগা হিলটন অবশেষে একদিন ক্ষেত্রমোহনের দ্বারস্থ হয়ে আরজি জানাল : ডাকাত পুঁটে সর্দারকে ঢিট করতে সাহায্য চাই। ক্ষেত্রমোহনও পুটের ওপর খুশি ছিলেন না। তাঁর প্রজাদের অনেকেই পুটের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে তাঁর কাছে। কিন্তু ইংরেজ আমলে একজন দিশি রাজা তো নিজের দায়িত্বে এসব করতে পারেন না। হিলটনের আরজিতে ক্ষেত্ৰমোহন রাজি হয়ে গেলেন। ক্ষেত্রমোহনের অত্যন্ত চালাক-চতুর একটি চর ছিল। তার নাম বিশু। সেই বিশুকে পুটে সর্দারের গতিবিধির খবর আনতে পাঠালেন ক্ষেত্রমোহন। বিশু দুদিন বাদে খবর এনে দিল, সামনে অমাবস্যায় গোবিন্দপুরে মদন সরখেলের বাড়িতে ডাকাতি হবে।
অমাবস্যার সেই রাতে গোবিন্দপুরে আর পৌঁছতে হয়নি পুটেকে। গোবিন্দপুরের লাগোয়া ময়নার মাঠে ক্ষেত্রমোহনের ফৌজ ঘিরে ফেলল তাদের। একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা তেমন কিছু নয়। পুটেকে ধরে আনা হল নবীগঞ্জে, ক্ষেত্রমোহনের দরবারে। পুটে সর্দার হাতজোড় করে বলল, “রাজামশাই, আমার বাপ আর পিতামহ আপনার বাপ আর পিতামহের ফৌজে ছিল। আমি কুলাঙ্গার, ফৌজে না এসে বেশি লাভের আশায় ডাকাতিতে নাম লেখাই। দোহাই মহারাজ, সাহেবদের হাতে দেবেন না, ওদের ওপর আমার বড় রাগ। যা শাস্তি হয় আপনিই দিন, গদান যায় তাও ভাল।”
ক্ষেত্রমোহন বিচক্ষণ লোক। মৃদু হাসলেন। সবাই জানে, ক্ষেত্রমোহনও ইংরেজদের মোটেই পছন্দ করেন না। তাঁর হাতের ইশারায় সেপাইরা পুঁটেকে হাজতে নিয়ে গেল। পরদিন সকালে এক নরসুন্দর এসে পুঁটের মাথাটা ন্যাড়া করে দিল। উড়িয়ে দিল পেল্লায় গোঁফজোড়াও। এর চেয়ে বেশি সাজা ক্ষেত্রমোহন দেননি।
ওদিকে হিলটন যখন খবর পেয়ে ধরতে এল তখন ক্ষেত্রমোহন সাহেবকে বললেন, “পুঁটে সর্দার আর ডাকাতি করবে না, তার হয়ে আমি কথা দিচ্ছি। কিন্তু তাকে আমার হেফাজতেই থাকতে দাও।”
হিলটন গাঁইগুঁই করল। পুঁটেকে ধরে দিলে তার কিছু বকশিশ পাওনা হয়। ক্ষেত্রমোহন বকশিশটা নিজের তহবিল থেকেই দিয়ে সাহেবকে বিদায় করলেন। পুঁটে আর তার দলবলকে ক্ষেত্রমোহন ফৌজে ভর্তি করে নিলেন।
পুঁটে সেই থেকে প্রতি মাসে ন্যাড়া হয়ে আসছে।
সেই ক্ষেত্রমোহন বহুদিন গত হয়েছেন। তস্য পুত্র পূর্ণচন্দ্রও আর নেই। তবে ক্ষেত্রমোহনের নাতি আজও আছে। তার নাম বীরচন্দ্র। নামে বীর হলেও বীরচন্দ্র মোটেই বীর নয়। সাঙ্ঘাতিক লাজুক প্রকৃতির বীরচন্দ্র রাজবাড়ির ভেতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে। কারও সঙ্গে দেখা করে না। একা-একা বীরচন্দ্র যে প্রাসাদের মধ্যে কী করে তা কেউ জানে না। বিয়েটিয়ে করেনি। রাজবাড়ির সেই জৌলুস নেই, দাস-দাসী, দরোয়ান, বরকন্দাজ ওসব কিছু নেই। থাকার মধ্যে এক বৃদ্ধ চাকর বনমালী আছে। আর আছে তোধিক বৃদ্ধ এক রাঁধুনি। একজন সরকারমশাইও আছেন বটে, কিন্তু আদায়-উশুল নেই বলে তিনি বসে বসে মাছি তাড়ান আর মাঝেমধ্যে বাজারহাট করে দেন।