বজ্র গম্ভীর স্বরে দু’বার কালী, কালী’ বলে শ্যামা রাস্তায় নেমে পড়ল। বৃষ্টির তোড় একটু বেড়েছে, বাতাসের জোরও। রাস্তাঘাট যেমন নির্জন তেমনই অন্ধকার।
দ্বিতীয় চেলা একটা টর্চ জ্বেলে বলল, “একটু দেখে চলবেন বাবা। রাস্তায় জল জমে গেছে।”
শ্যামা সবেগে জল ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ওরে, টর্চের আলোতে কি আমি পথ দেখি? আমি দেখি ধ্যানের চোখে, তৃতীয় নয়নে। সামনে মা হাঁটছেন, দেখতে পাচ্ছিস না? ওই দ্যাখ শ্যামা মা কেমন মল বাজাতে বাজাতে চলেছেন। দেখতে পাচ্ছিস?”
“আমাদের পাপী চোখ বাবা, এই চোখে কি দেখা যায়?”
“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
অট্টহাসি শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ দশাসই চেহারা নিয়ে গদাম করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল শ্যামা। তারপরই আর্ত চিৎকার, “বাবা রে!”
চেলা দু’জন পেছনে ছিল। এ ঘটনায় হতচকিত হয়ে টর্চ জ্বালাতেই তারা দেখতে পেল, কোনও বদমাশ রাস্তার দু’ধারে দুটো গাছে আড়াআড়ি একটা দড়ি বেঁধে রেখেছে। তাইতেই পা বেঁধে পড়ে গেছে শ্যামা।
“ওরে, হাঁ করে দেখছিস কী? ধরে তোল!” শ্যামা চেঁচাল। চেলারা গিয়ে তাড়াতাড়ি টেনে তুলল শ্যামাকে। জলে কাদায় দাড়ি গোঁফ রক্তাম্বর সব মাখামাখি। মাজায় চোটও হয়েছে। হাঁফাতে হাঁফাতে শ্যামা বলল, “কোন বদমাশ …?”
সামনের অন্ধকার থেকে কে যেন বলে উঠল, “এটা হল এক নম্বর।”
“কে? কে রে বদমাশ? কে ওখানে?”
কেউ জবাব দিল না।
চেলাদের একজন ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “একটু পা চালিয়ে চলুন বাবা, এ তো বেহ্মদত্যির গলা বলে মনে হচ্ছে।”
শ্যামা খচিয়ে উঠে বলে, “নিকুচি করেছি ব্ৰহ্মদত্যির। টর্চের আলোটা ভাল করে ফেল তো, হাঁটু দুটোর ছালবাকল বোধ হয় উঠেই গেছে। গতকাল মাঝরাত্তিরে মা ব্রহ্মময়ী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন বটে, তোর একটা ফাঁড়া আসছে, পথেঘাটে সাবধান। তা কথাটা খেয়াল ছিল না।”
চেলার টর্চের আলোয় দেখা গেল, দুটো হাঁটুরই নুনছাল উঠেছে।
শ্যামা তান্ত্রিক চাপা গলায় বলল, “ঘটনাটার কথা কাউকে বলার দরকার নেই। বুঝলি?”
দু’জনে একসঙ্গেই বলে উঠল, “যে আজ্ঞে।”
আর তৃতীয় নয়নের ওপর ভরসা হল না শ্যামা তান্ত্রিকের। একজন চেলা সামনে টর্চ জ্বেলে পথ দেখাতে লাগল, অন্যজন ছাতা ধরে রইল। শ্যামা তান্ত্রিক ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ডেরার দিকে হাঁটতে লাগল।
টর্চওলা চেলা বলল, “ব্যাপারটা কিন্তু ভয়েরই হয়ে দাঁড়াল বাবা।”
শ্যামা বলল, “কোন ব্যাপারটা?”
“ওই যে কে একজন বলল এটা এক নম্বর। তার মানে এর পর দু’নম্বর, তিন নম্বর, চার নম্বর হতে থাকবে। কোথায় গিয়ে শেষ হবে আন্দাজ করতে পারছে কি?”
মুখটা বিকৃত করে শ্যামা তান্ত্রিক বলল, “ভয়ের কিছু নেই। কোনও বদমাশ ছেলেপুলে কাণ্ডটা করে রেখেছিল। দাঁড়া না, আজ রাতে পঞ্চমুণ্ডির আসনে ধ্যানে বসলেই সব জানতে পারব।”
ছাতা-ধরা লোকটা বলল, “কিন্তু গলাটা তো বাচ্চা ছেলেপুলের বলে মনে হল না। বেশ ভারী গলা।”
“বললুম তো, যে-ই হোক এই শর্মার কাছে তার পরিচয় গোপন থাকবে না। ধ্যানে বসলেই বায়োস্কোপের ছবির মতো সব ভেসে উঠবে চোখের সামনে। তবে একাজ কার তা বুঝতে আমার বাকি নেই।”
টর্চওলা সোৎসাহে বলল, “কে বটে বাবা?”
“কে আবার, ওই তারা তান্ত্রিক। তন্ত্রের তোত-ও জানে না, গুলগাপ্পা দিয়ে কিছু লোকের মাথা খেয়েছে। এখন তন্ত্রের শক্তিতে
পেরে এইসব হীন পন্থায় জব্দ করার চেষ্টা করছে আমাকে। ভীম যেমন দুঃশাসনের রক্ত পান করেছিল, আমারও তেমনই ইচ্ছে যায় ব্যাটাকে বুকে হাঁটু দিয়ে”
ছাতাওলা বলল, “কুপিত হবেন না বাবা, আপনি কুপিত হলে সর্বনাশ।”
“কিন্তু লোকটার কেমন বাড় বেড়েছে দেখেছিস! ওর চেলাচামুণ্ডারা হল সব চোর-চোট্টাবদমাশ। তাদের কাউকে দিয়েই কাণ্ডটা করিয়েছে। দাঁড়া, আমিও দেখাচ্ছি মজা।”
টর্চলা বলল, “তারা তান্ত্রিকের কিন্তু আজকাল খুব নাম হয়েছে বাবা। অনেকে বলে, তারা তান্ত্রিকের অনেক ক্ষমতা।”
শ্যামা হুঙ্কার দিল, “কাঁচ্চা খেয়ে নেব। মা কালীর সামনে হাড়িকাঠে বলি দেব ব্যাটাকে।”
৪. জ্ঞানপাগলা
জ্ঞানপাগলা আজকাল তাঁর বাড়ির বারান্দাতেই রাতে এসে শোয়। তাই আজ নরহরি সজাগ ছিলেন। জ্ঞান যে সোজা লোক নয় তা আজ তিনি ভাল করেই বুঝে গেছেন। গিন্নিকে বললেন, “ওগো, জ্ঞান কিন্তু ছদ্মবেশী লোক। বোধ হয় পাগল হওয়ার আগে প্রফেসর টফেসর কিছু ছিল। হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। অমন শক্ত শব্দটার অর্থ কেমন পট করে বলে দিল বলে দিকিনি। এক কাজ করো, আজ রাতে পাগলটাকে ভাল করে ভাতটাত খাওয়াও। আর বাইরের ঘরে একটা বস্তা আর চাঁদর পেতে বিছানাও করে দাও। বাইরে এই বৃষ্টিবাদলায় শুয়ে অসুখ করলে আমাদের পাপ হবে।”
গিন্নি পাপকে ভারী ভয় পান। বললেন, “তার তো আবার বড় দেমাক, এটোকাঁটা খাবে না।”
“এঁটোকাঁটা দেওয়ার দরকার কী? ভাল করেই খাওয়াও।”
নরহরি তক্কে তক্কে ছিলেন। রাত দশটা নাগাদ গজানন একটা ছাতা মাথায় ধরে জ্ঞানকে পৌঁছে দিয়ে যেতেই নরহরি বেরিয়ে এসে বিগলিত হয়ে বললেন, “ওরে জ্ঞান, আজ আর বাইরের বারান্দায় কষ্ট করে শুতে হবে না বাবা, আয় ঘরে তোর বিছানা পেতেছি।”
জ্ঞান তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, “দুর! ঘরে শুলে এতবড় রাজ্যপাট দেখবে কে? চারদিকে নজর রাখতে হবে না?”