সজনীবাবু বলেন, “রাজপুত্তুর! বাঃ বেশ! তা কোথাকার রাজপুত্তুর তা জানেন?”
নৃপেনবাবু মুখোনা বিকৃত করে বললেন, “পাগলের কথার কি মাথামুণ্ডু আছে! সে নাকি নয়নগড়ের রাজপুত্তুর। নয়নগড়ের নাম তো জন্মে শুনিনি বাপু।”
সজনীবাবু হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
হরিপ্রিয় বললেন, “নবাবগঞ্জে নতুন নতুন চিড়িয়া আসছে কিন্তু। একটা তান্ত্রিক, একটা পাগল, আরও কে আসে কে জানে বাবা।”
সুধীর বৈষ্ণব বললেন, “আসুক, আসুক, যত আসবে ততই খেল জমবে।”
চা আর পাঁপড়ভাজা খেয়ে শুধু শ্যামা তান্ত্রিক ছাড়া সবাই উঠে পড়লেন। রাত প্রায় ন’টা বাজে। বাইরে এখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়াও দিচ্ছে খুব। রাস্তাঘাট খুবই ফাঁকা।
সজনীবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু তফাতে এসেই নৃপেনবাবু খ্যাঁক করে উঠলেন, “সজনীবাবুর আক্কেলটা দেখলে সুধীরভায়া? কথা নেই, বার্তা নেই, দুম করে একটা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করে বসলেন! কেন বাপু, আমরা কি ওঁর ইস্কুলের পড়ুয়া নাকি? এ তো ঘোর অপমান!”
সুধীরবাবু বললেন, “টাকার গরম, দেমাকের গরম সব মিলিয়ে লোকটা একেবারে টং হয়ে আছে।”
হরিপ্রিয় বললেন, “ওরে বাপু, টাকাটাও তো করেছে বাঁকা পথে। কাজকারবার তো কিছু তেমন দেখছি না, কিন্তু লাখ-লাখো টাকা যে কোত্থেকে আসছে কে জানে। তুমি কী বলল হে গবাক্ষভায়া?”
গবাক্ষবাবু বললেন, “সত্যি কথাই বলেছেন। সজনীবাবুকে নিয়ে একটা রহস্য আছে।”
নৃপেনবাবু বললেন, “আমার তো মনে হয় ওই শ্যামা তান্ত্রিকের সঙ্গে সাঁট করে ভেতরে ভেতরে কোনও কাজকারবার চলছে।”
সুধীরবাবু একমত হয়ে বলেন, “তাও হতে পারে।”
বটতলার গজাননের তেলেভাজার দোকানে ঝাঁপের তলায় গুটিসুটি মেরে বসা জ্ঞানপাগলাকে দেখে নৃপেনবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “জ্ঞানপাগলা না?”
গবাক্ষবাবু বললেন, “হ্যাঁ, জ্ঞানপাগলাই। গজানন জ্ঞানপাগলাকে রোজ রাতে পরোটা আর আলুর দম খাওয়ায়।”
নৃপেনবাবু অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী? কেন, খাওয়ায় কেন?”
“গজানন মনে করে জ্ঞানপাগলা সত্যিই রাজপুত্তুর। শুধু গজানন কেন, নবাবগঞ্জের অনেকেরই ধারণা জ্ঞানপাগলা সাধারণ লোক নয়।”
“হুঁঃ, যত্তসব আহাম্মক। রাজপুত্তুর আজকাল গাছে ফলছে কি না। রাজপুত্তুর হওয়া অত সোজা নয়।”
এত লোককে একসঙ্গে মুখোমুখি দেখে জ্ঞানপাগলা জুলজুল করে চেয়ে মাথার রঙিন টুপিটা খুলে মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে বলল, “তোমরা কি খাজনা দিতে এসেছ?”
নৃপেনবাবু পয়সাওলা লোক, ফস করে পকেট থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে বললেন, “নিবি? আর একটা শক্ত কথার মানে বলে দে দিকিনি বাবা।”
জ্ঞানপাগলা কুটি করে বলল, “কেন, আমি কি ডিকশনারি নাকি?”
“সবাই বলে তুই জ্ঞানী মানুষ। পাগল সেজে থাকিস বটে, কিন্তু জ্ঞানের নাড়ি টনটনে।”
জ্ঞান চোখ পাকিয়ে বলে, “পাগল! আমি পাগল! আমি হলুম নয়নগড়ের যুবরাজকুমার। খবর্দার ফের ওকথা উচ্চারণ কোরো না।”
জোড়হাত করে নৃপেনবাবু বললেন, “ভুল হয়ে গেছে রে বাপু, মাপ করে দে। বুড়োমানুষ, সবসময়ে সব কথা খেয়াল থাকে না। এই যে আরও পাঁচটা টাকা।”
টাকা পকেটে গুঁজে জ্ঞান বলল, “কী জানতে চাও?”
“এসকলাশি শব্দটার মানে বলতে পারিস বাবা?”
“দুর! এসব তো ইংরিজি শব্দের অপভ্রংশ। পরীক্ষায় ভাল ফল করলে আমার ঠাকুমা বলে বেড়াত, আমার নাতি এসকলাশি পেয়েছে। এর মানে হচ্ছে জলপানি, স্কলারশিপ।”
চারজন একটু মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। হরিপ্রিয় মৃদু স্বরে বললেন, “মনে হয় ঠিকই বলছে।”
সুধীরবাবুও বললেন, “আমারও তাই মনে হচ্ছে।” নৃপেনবাবু পাঁচ পাঁচ দশ টাকা খসিয়ে শব্দটার মানে জেনেছেন। তিনি শুধু বললেন, “হু।”
জ্ঞানপাগলা বলল, “খাজনার কথা এত ভুলে যাও কেন? ভূস্বামীকে যদি তার পাওনা না দাও তা হলে মাটির অভিশাপ লাগে, জানো?”
নৃপেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমরা আবার কবে তোর প্রজা হলুম কে জানে বাবা। তবে তুই জ্ঞানী মানুষ, মাঝে মাঝে খাজনা তোকে দিতে হবে দেখছি।”
জ্ঞানপাগলা একটু ছটাক খানিক হেসে বলল, “খাজনা আদায় করতেই তো আসা।”
.
ওদিকে সজনীবাবু তাঁর ঘরে কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থেকে হঠাৎ বললেন, “শ্যামাদা, জ্ঞানপাগলটা আসলে কে বলো তো?”
শ্যামা নিমিলিত নেত্রে চেয়ে বলল, “কেন, বাণ টান মারতে হবে নাকি?”
“না, না, ওসব নয়। আগে খোঁজ নাও লোকটা কে, কত বয়স, কোথা থেকে আসছে।”
“কালকেই খোঁজ নিচ্ছি, চিন্তা নেই।”
“ভাল করে খোঁজ নিয়ো। আজেবাজে গুজবে কান দিয়ো না।”
“আরে না, ভাল করেই খোঁজ নেব। দরকার হলে মহেশ দারোগাকে লাগিয়ে দেব। মহেশ আমাকে খুব খাতির করে।”
“আহা, অত হট্টগোল পাকিয়ে দরকার কী? মহেশকে বললে সে হয়তো পাগলকে কোমরে দড়ি দিয়ে থানায় নিয়ে যাবে, তোক জানাজানি হবে। আমি চাইছি গোপনে খবর নিতে, কেউ যেন টের না পায়।”
“তারও ভাবনা নেই। বিশেকে লাগিয়ে দেব’খন। সে চোর ছ্যাঁচড় যাই হোক, খুব চালাক চতুর। পেটের কথা টেনে বের করতে তার জুড়ি নেই। তবে সে মজুরি চাইবে।”
“কত চাইবে?”
“গোটা পঞ্চাশেক টাকায় হয়ে যাবে।”
সজনীবাবু টাকাটা বের করে দিয়ে বললেন, “কালই খবর চাই।”
টাকাটা ট্যাকে গুঁজে শ্যামা তান্ত্রিক উঠে পড়ল। বাইরে তার দু’জন চেলা অপেক্ষা করছিল, শ্যামা বেরোতেই দু’জন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। একজন একটা ছাতা মেলে ধরল শ্যামার মাথার ওপর।