সজনীবাবু মৃদু হেসে বললেন, “চোরের সঙ্গে কথা! আপনি তো তা হলে বেশ আলাপি লোক।”
একটু হেঁ হেঁ করে গবাক্ষ বললেন, “আজ্ঞে আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ওই গুণটা আমার আছে বটে।”
নৃপেন বৈরাগী বলল, “আহা, কথাটা কী হল সেটাই বলো না! বাজে কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “হ্যাঁ, চোরটা বলছিল সজনীবাবুকে এ যুগের যুধিষ্ঠির বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিংবা নবাবগঞ্জের গান্ধী। চোরদের এক সর্দার নাকি একবার সজনীবাবুর বাড়িতে ঢুকে ধরা পড়েছিল। তার নাম লক্ষ্মীকান্ত। তা সজনীবাবু তাকে শুধু ক্ষমাই ৩০
করেননি, কোথায় যেন একটা দোকান করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। সত্যি নাকি সজনীবাবু?”
সজনীবাবু উদাস নয়নে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হবে। কত লোককেই তো রোজ ক্ষমা করতে হয়, কে তার হিসেব রাখে বলুন।”
হরিপ্রিয় বলে উঠলেন, “সে তো বটেই, সে তো বটেই।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “চোরটা কিন্তু একটা ভয়ের কথাও বলল।”
নৃপেন বৈরাগী বলেন, “ভয়ের কথা। সে আবার কী?”
“চোরেরা নাকি তারা তান্ত্রিক নামে একজন নতুন তান্ত্রিককে পেয়ে গেছে। তার নাকি অনেক ক্ষমতা।”
এতক্ষণ শ্যামা তান্ত্রিক নিশ্চল হয়ে বসে ছিল। একথা শুনেই হঠাৎ ‘ব্যোমকালী’ বলে এমন হুঙ্কার ছাড়ল, সবাই চমকে উঠল। শ্যামা তান্ত্রিক গুরুগম্ভীর গলায় বলল, “কাঁচা খেয়ে নেব তাকে। বাণ মেরে এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দেব। তার মুণ্ডু নিয়ে–”
সজনীবাবু ভারী মোলায়েম গলায় বললেন, “ছাড়ুন তো শ্যামাদা। কোথাকার কে এক চুনোপুটি তারা তান্ত্রিককে নিয়ে খামোখা উত্তেজিত হচ্ছেন। আমরা তো জানি আপনার মতো তন্ত্রসিদ্ধ মানুষ কমই আছে। ক্ষমাই করে দিন না।”
শ্যামা তান্ত্রিক আবার একটু মিইয়ে গেল। মৃদুস্বরে কালী, কালী’ বলতে বলতে চোখ বুজে ফেলল।
সুধীর বৈষ্ণব একটু ফিচেল হাসি হেসে বললেন, “শ্যামাদাদা আগে খুব তারা, তারা’ জপ করতেন, তারা তান্ত্রিকের ওপর খাপ্পা হওয়ার পর থেকে আর ও নাম উচ্চারণও করেন না।”
একথায় শ্যামা তান্ত্রিক চোখ খুলে সুধীরবাবুকে ভস্ম করে দেওয়ার একটা অক্ষম চেষ্টা করতে করতে বলল, “সে নির্বংশ হবে, তার চেলারাও নির্বংশ হবে। মাথায় বজ্রাঘাত হবে–”
সজনীবাবু আবার মৃদুস্বরে বললেন, “আহা, শ্যামাদা, মাথা গরম করবেন না। আপনি চটলে যে মহাপ্রলয় হয়ে যাবে।”
শ্যামা আবার মিইয়ে গেল। গবাক্ষবাবু বললেন, “আরও একটা খবর আছে, বলব কি?”
হরিপ্রিয় বললেন, “আহা, খবরটবরের জন্যই তো এখানে আসা। বলে ফেলো, বলে ফেলল।”
“শুনলুম, জ্ঞানপাগলা নাকি কল্যবৰ্ত কথাটার মানে আগেই নরহরিবাবুকে বলে দিয়েছিল। তখন নরহরিবাবুর বিশ্বাস হয়নি বটে, কিন্তু পরে দেখলেন, পাগলা ঠিকই বলেছিল।”
নৃপেনবাবু হঠাৎ খেচিয়ে উঠে বললেন, “এ, জ্ঞানপাগলা বড় পণ্ডিত এসেছেন কিনা। কল্যবর্ত মানে তো আমরাও জানতুম। কী বলল সুধীর, কী বলল হরিপ্রিয়?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই তো।”
“হেডমাস্টার তেজেনবাবু যখন আমাদের জব্দ করার জন্য উলটে আমাদেরই কল্যবর্ত মানে জিজ্ঞেস করল তখন আমরা তো বুক ফুলিয়েই বলে দিলাম যে, কল্যবর্তমানে সকালের জলখাবার। শুনে তেজেনবাবু চুপসে গেলেন।”
সজনীবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি? তা হলে তো বলতে হয় আপনারা বেশ জ্ঞানী লোক।”
নৃপেনবাবু লজ্জার ভাব করে বললেন, “না, না, এ আর এমন কী!”
সজনীবাবু মৃদু-মৃদু হেসে বললেন, “আমি আরও একটা শব্দ নিয়ে বড় ধন্ধে পড়েছি। তা আপনারা জ্ঞানী মানুষ, বলতে পারেন
এসকলাশি শব্দটার সঠিক অর্থ কী হবে?”
নৃপেনবাবু হঠাৎ শশব্যস্তে উঠে পড়ে বললেন, “এই রে, নাতিটার সকাল থেকে জ্বরভাব, দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে যেতে হবে। একেবারে মনে ছিল না।”
সুধীরবাবুও তড়াক করে উঠে পড়ে বললেন, “গেল বোধ হয় আমার ছাতাটা। ভুল করে ছাতাটা দিনু মুদির দোকানে ফেলে এসেছি।”
উঠি-উঠি ভাব করে হরিবাবু বললেন, “সকাল থেকে মাথাটা ঘুরছে। শশধর ডাক্তারকে একবার প্রেশারটা না দেখালেই নয়।”
তিনজনেই উঠে পড়েছে দেখে সজনীবাবু মৃদু হেসে বললেন, “আরে তাড়া কীসের? শব্দটার অর্থ আজ না বললেও চলবে। বসুন, বসুন, চা আর পাঁপড়ভাজা আসছে।”
তিনজনেই ফের বসে পড়লেন।
সজনীবাবু তাঁর শান্ত চোখে গবাক্ষবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই জ্ঞানপাগলাটা কে বলুন তো! আগে তো নাম শুনিনি!”
গবাক্ষবাবু বললেন, “নাম শোনার কথাও নয়। এই নতুন এসেছে। আজ সকালেই তো নরহরির বারান্দার সিঁড়িতে বসে ছিল, দেখেননি? মাথায় রঙিন টুপি, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল।”
“অ। তা দেখে থাকব হয়তো, ভাল করে খেয়াল করিনি। তা সে কেমন পাগল?”
গবাক্ষবাবু বলার আগেই নৃপেনবাবু বলে উঠলেন, “খুব দেমাকের পাগল মশাই, কারও বাড়িতে এটোকাঁটা খাবে না, ফাঁইফরমাশ খাটবে না।”
হরিপ্রিয় বললেন, “ফিলজফার ফিলজফার ভাব। মুখ গোমড়া করে সবসময়ে কী যেন ভাবে।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “একটা মজা আছে, ভিক্ষেটিক্ষে চায় না।”
সজনীবাবু বললেন, “তবে চলে কীসে?”
নৃপেনবাবু বললেন, “লোকে এমনিতেই দেয়। ছদ্মবেশী মহাপুরুষ বলেই ভাবে বোধ হয়।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “সে নাকি কোথাকার রাজপুত্তুর। লোকের কাছে পয়সা চাওয়ার সময় বলে, ভিক্ষে নয় বাপু, খাজনা নিচ্ছি।”