নরহরির পা দুটো কাঁপতে লাগল, বুকে ধড়ফড়ানি। চোখে হলুদ-হলুদ ফুলও দেখতে লাগলেন। তবু মরিয়া হয়ে বুক ঠুকে এগিয়েও গেলেন। মরতেও তো একদিন হবেই।
হেডসারের ঘরে মাস্টারমশাইরা জড়ো হয়েছেন। জনাচারেক অভিভাবক বসে আছেন। সকলের মুখেই আষাঢ়ের মেঘ।
তেজেনবাবু নরহরিকে দেখে বললেন, “বসুন। আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এসেছে। কয়েকজন অভিভাবক দরখাস্ত করেছেন আপনাকে বরখাস্ত করার জন্য। আপনি নাকি কী একটা শব্দের অর্থ সজনীবাবুকে বলতে পারেননি।”
নরহরি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, কল্যবর্ত।”
তেজেনবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “পৃথিবীর সেরা পণ্ডিতরাও সব শব্দের অর্থ জানেন না। যাই হোক, অভিভাবকরা কেউ কি শব্দটার অর্থ জানেন?”
অভিভাবকরা একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। নৃপেন বৈরাগী বললেন, “এর মানে হচ্ছে ইয়ে আর কি। ওই যে–যাকে বলে–”
আর এক অভিভাবক সুধীর বৈষ্ণব বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তো–খুব সোজা মানে, ওটা হচ্ছে গিয়ে–”
তৃতীয় অভিভাবক হরিপ্রিয় দাস বললেন, “আরে কলিকালের শেষ যখন হয় তখনই হয় কল্যবর্ত।”
তেজেনবাবু গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “আপনারা বসুন, দক্ষিণাবাবুকে লাইব্রেরি থেকে বাংলা অভিধান আনতে পাঠিয়েছি। তিনি এলেন বলে।”
কথা শেষ হতে না-হতেই হন্তদন্ত হয়ে দক্ষিণাবাবু এসে ঢুকলেন। হাতে মহাভারতের সাইজের অভিধান। ঢুকেই বললেন, “অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!”
তেজেনবাবু বললেন, “অবিশ্বাস্যটা কী?”
“আজ্ঞে, এরকম একটা শক্ত শব্দের অর্থ যে এত সোজা সেটাই অবিশ্বাস্য।”
“মানেটা তো বলবেন।”
“কল্যবর্ত মানে হচ্ছে প্রাতরাশ, অর্থাৎ সকালের জলখাবার। ব্রেকফাস্ট।”
সবাই হাঁ হয়ে থাকলেন।
তেজেনবাবু মুচকি একটু হেসে অভিভাবকদের দিকে চেয়ে বললেন, “শুনলেন তো! আমি নরহরিবাবুর কোনও দোষ দেখছি না। শব্দটার অর্থ আপনাদের মতো আমাদেরও জানা ছিল না। এবার আপনারা আসুন গিয়ে।”
অভিভাবকরা ঠেলাঠেলি করে বেরিয়ে গেলেন। তেজেনবাবু মাস্টারমশাইদের দিকে চেয়ে বললেন, “আপনারা সবাই যে যার ক্লাসে যান। নরহরিবাবুর ব্যাপারটা নিয়ে ছাত্ররা যাতে আলোচনা না করে সেদিকে লক্ষ রাখবেন।”
সবাই চলে গেলেও নরহরিবাবু বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
তেজেনবাবু বললেন, “আপনি ঘাবড়াবেন না। সজনীবাবু প্রকাশ্যে আপনাকে শব্দটার অর্থ জিজ্ঞেস করে অন্যায় করেছেন। আমরা আপনার পক্ষেই আছি। তবে সজনীবাবু খামখেয়ালি লোক, তাঁর প্রতাপও দোর্দণ্ড। তিনি কী করবেন তা জানি না।”
নরহরিবাবু সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, “তেজেনবাবু একটা কথা।”
“কী কথা?”
“কল্যবর্তমানে যে সকালের জলখাবার, এটা জ্ঞানপাগলা আমাকে বলে দিয়েছিল।”
“অ্যাাঁ, বলেন কী! পাগলাটা জানল কী করে? আমরাই জানতাম না।”
“তাই তো ভাবছি।”
৩. অগ্রহায়ণ মাসের শেষ
অগ্রহায়ণ মাসের শেষ। শীতের শুরুতে বেশ জম্পেশ করে বৃষ্টি নেমেছে সন্ধেবেলা। নবাবগঞ্জের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে এসেছে। তবু বৃষ্টির মধ্যেই জনাচারেক আড্ডাধারী ছাতা মাথায় দিয়ে এসে সজনীবাবুর বৈঠকখানায় জড়ো হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটা জলচৌকির ওপর আসনপিড়ি হয়ে শ্যামা তান্ত্রিকও বসা।
হাতটাত কচলে হেঃ হেঃ করে বিগলিত হাসি হেসে গবাক্ষবাবু বললেন, “ওঃ, আজ সকালে যা একখানা দিলেন না সজনীবাবু, একেবারে গুগলি। নরু মাস্টারের আর বাক্য সরল না।”
সজনীবাবু খুব উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “নরু মাস্টার কে?”
“আরে আমাদের অভয় বিদ্যাপীঠের বাংলার মাস্টার নরহরি।”
“ওঃ, তা হবে। তা তাকে সকালে কিছু বলেছি নাকি?”
গবাক্ষ অবাক হয়ে বলেন, “বলেননি? সেই যে কল্যবর্ত শব্দের মানে জিজ্ঞেস করলেন আর নরু মাস্টার হাঁ হয়ে গেল! সারা গাঁয়ে তো টি-টি পড়ে গেছে তাই নিয়ে।”
সুধীরবাবু বললেন, “আমরা তো গণ দরখাস্ত নিয়ে ইস্কুলে গিয়ে নরু মাস্টারকে বরখাস্ত করার দাবি পর্যন্ত জানিয়েছি।”
সজনীবাবু উদাস নয়নে দেওয়ালের দিকে চেয়ে বললেন, “আহা, মাস্টার মানুষ, ক’টা পয়সাই বা মাইনে পায়। ও চাকরি তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। বেচারাকে বরখাস্ত করার দরকারটাই বা কী? আছে থাক।”
নৃপেন বৈরাগী হেঁঃ হেঃ করে বলল, “আপনার মতো দয়ার শরীর আর দেখিনি। মহাশত্রুকেও হাসিমুখে ক্ষমা করে দিতে পারেন।”
সজনীবাবু করুণ গলায় বললেন, “এই শ্যামাদাও আমাকে একটু আগে বলছিলেন নরহরি মাস্টারের চাকরিটা যাতে না খাই। আমি ভাবি, চাকরি খাওয়ার মতো পাষণ্ড তো নই রে বাপু।”
গবাক্ষবাবু বিগলিত হয়ে বললেন, “পাষণ্ড! আপনাকে পাষণ্ড বলবে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? সাধারণ মানুষের কথা ছেড়ে দিন, এমনকী চোর-ডাকাতরাও আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই তো কাল রাতেই আমার বাড়িতে একটা চোর ঢুকেছিল–”
হরিপ্রিয়বাবু অবাক হয়ে বললেন, “আপনার বাড়িতে চোর? বলেন কী মশাই? এমন আহাম্মক চোর ভূ-ভারতে আছে নাকি? সবাই জানে আপনি চোর-ডাকাতের ভয়ে আপনার সব টাকা-পয়সা আর দামি জিনিসপত্র নয়াগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে গচ্ছিত রেখেছেন। চোর তবে কীসের আশায় এসেছিল?”
একথাটায় খোঁচা ছিল বলে একটু লজ্জা পেয়ে গবাক্ষবাবু বললেন, “সেকথা অস্বীকার করছি না। চোরটা যে কেন এসেছিল সেটাও ভেঙে বলেনি। তবে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হল।”