ফেরার সময় নরহরিবাবু আর লোকালয় দিয়ে ফিরলেন না। একটু ঘুরে মাঠ-ময়দান ভেঙে, বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে উদাসভাবে হাঁটতে লাগলেন। তারপর একটা বটতলায় বসে পরিস্থিতিটা ভাবতে লাগলেন। চাকরি গেলে কী হবে তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। সামনে যেন ধুধু মরুভূমি। তার ওপর লোকলজ্জা। অনেক ভেবেচিন্তে হঠাৎ শ্যামাপদ তান্ত্রিকের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।
সজনীবাবু শ্যামা তান্ত্রিকের কথায় ওঠেন বসেন। ময়না নদীর ধারে একখানা কালীমন্দিরও বানিয়ে দিয়েছেন তাকে। শ্যামা তান্ত্রিক সেখানে সাধনভজন করে, মারণ উচাটন করে। তার নাকি পোষা ভূতও আছে। শ্যামা তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে হত্যে দিলে এ-যাত্রায় বেঁচেও যেতে পারেন নরহরি! অন্ধকারের মধ্যে একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে নরহরি উঠে পড়লেন।
দেদার ঘি-দুধ আর পাঁঠার মাংস খেয়ে শ্যামা তান্ত্রিকের চেহারাটা হয়েছে পেল্লায়। রাগী মানুষ। ভক্তরা ট্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে তেড়ে আসে। তল্লাটে তার বেজায় প্রতাপ, সবাই ভয় খায়। নরহরি যখন গুটি গুটি শ্যামা তান্ত্রিকের ডেরায় হাজির হলেন তখন তাঁর পিলে চমকানোর মতো অবস্থা। মন্দিরের বারান্দায় শ্যামা তান্ত্রিক রক্তাম্বর পরে বসা, কপালে কুটি। সামনে বসা দশ-বারোজন ভক্তের দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বিকট গলায় চেঁচাচ্ছে, “কাঁচ্চা খেয়ে ফেলব, কাঁচ্চা খেয়ে ফেলব বলে দিলাম! নিয়ে আয় ব্যাটাকে ধরে, দেখি তার ধড়ে ক’টা মুণ্ডু আছে! তন্ত্রমন্ত্র দেখাতে এসেছে নবাবগঞ্জে! এখনও তো চেনেনি এই শর্মাকে! এখনও জানে না, এই দশখানা গাঁ জুড়ে গোটা এলাকার ওপর আমার দখল। হুঁ, তারা তান্ত্রিক! তন্ত্রের ব্যাটা জানেটা কী? কিছু নয়, কিছু নয়। পাছে বিদ্যে ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ানোর হিম্মত নেই। ব্যাটা গিয়ে জটেশ্বরের জঙ্গলে পুরনো শ্মশানে থানা গেড়েছে। যতসব চোরচোট্টা বদমাশরা গিয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে।” শ্যামা তান্ত্রিকের মেজাজ দেখে সবাই তটস্থ। শ্যামা হঠাৎ হুঙ্কার ছাড়ল, “তোমরা কেউ যাও নাকি ওখানে?” সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “আজ্ঞে না।”
“খবর্দার যাবে না। ও জোচ্চোর লোক, ভুলভাল মন্তর পড়ে তোমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। বুঝেছ?”
সবাই বলে উঠল, “যে আজ্ঞে।” তারা তান্ত্রিকটা কে তা নরহরি জানেন না। তবে এটা বুঝতে কষ্ট নেই যে, জনৈক তারা তান্ত্রিকের সঙ্গে শ্যামা তান্ত্রিকের একটা অদৃশ্য লড়াই চলছে। কথায় বলে ঠেকায় পড়লে বুদ্ধি খোলে, নরহরির মাথাতেও একটা দুষ্টবুদ্ধি চিড়িক দিয়ে উঠল। তিনি ভক্তদের মধ্যে বসে পড়ে হাতজোড় করে বললেন, “আজ্ঞে আমাকেও লোকে টানাটানি করেছিল বটে তারা তান্ত্রিকের কাছে যাওয়ার জন্য।”
শ্যামা তান্ত্রিক বজ্রপাত ঘটানোর মতো গলায় হুঙ্কার ছাড়ল, “বটে! বটে! কার এত বুকের পাটা?”
“কিছু পাজি লোক। তবে আমি যাইনি। ভাবলুম আমাদের শ্যামা মহারাজ থাকতে তারা তান্ত্রিকের কাছে যাব কেন! ওস্তাদ থাকতে আনাড়ির কাছে কেউ যায়?”
শ্যামা তান্ত্রিক একটু নরম হল। গলা এক পরদা নামিয়ে বলল, “তুই অভয় ইস্কুলের মাস্টার না?”
“যে আজ্ঞে বাবা। বড় বিপদে পড়ে এসেছি।”
“আরে বিপদে পড়েই তো লোকে আমার কাছে আসে। আমি হলুম বিপত্তারণ। তা তোর বিপদটা কীসের?”
“আজ্ঞে চাকরি যায় যায়।”
“কেন, কেন, চাকরি যাবে কেন?”
একজন ভক্ত ফস করে বলে উঠল, “আজ্ঞে, উনি কৈবল্য শব্দের মানে বলতে পারেননি, সেইজন্য সজনীবাবু খুব চটে গেছে।”
“কৈবল্য!” বলে হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হাসল শ্যামা তান্ত্রিক। তারপর হাসি-হাসি মুখেই বলল, “কৈবল্য, কেবল কৈবল্য। কেবলম, কেবলম। কৈবল্য হচ্ছে ওই করাল কালী। কালী কৈবল্যদায়িনী। বুঝলি।”
হাতজোড় করে নরহরি বললেন, “আজ্ঞে বুঝেছি। তবে কথাটা কৈবল্য নয়, কল্যবর্ত।”
“কী, কী বললি?”
“আজ্ঞে, কল্যবর্ত।”
“কল্যবর্ত।” আবার হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে শ্যামা তান্ত্রিক বলল, “ঘুরছে, ঘুরছে, সব ঘুরছে। বুঝলি? স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে ঘুরছে, বিঘূর্ণিত হচ্ছে মহাকাশ। সত্য-স্রেতা-দ্বাপরকলি সব চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে ওই কাল। মহাকাল। কালের আবর্ত রে, মহাকালের ঘূর্ণিঝড়। আর তাকেই বলে কল্যবর্ত। বুঝেছিস?”
“আজ্ঞে, আপনি মহাজ্ঞানী। এবার জলের মতো বুঝেছি।”
“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
“কিন্তু চাকরিটা গেলে যে মহাকালের ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাব মহারাজ।”
শ্যামা তান্ত্রিক দুলে দুলে একটু হেসে বলল, “পারবে ওই তারা জোচ্চোর এর মানে করতে? কেন যে লোকে ঠকবাজটার কাছে যায়। এবার ওকে কাঁচ্চা খেয়ে নেব। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।”
নরহরি কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “খুব ভাল হয় তা হলে মহারাজ।”
শ্যামা তান্ত্রিক তাঁর দিকে একটু কুটিল নয়নে চেয়ে বলল, “খবর্দার, ওই তারা জোচ্চোরটার কাছে যাস নে। আমি সজনীকে বলে দেব’খন তোর চাকরিটা যাতে বজায় থাকে।”
পাঁচখানা টাকা প্রণামী দিয়ে নরহরি উঠে পড়লেন। বুকে একটু বল পাচ্ছেন এখন।
মনটা ভাল নেই। কথাটা চারদিকে রটে গেছে। ইস্কুলেও এই নিয়ে কথা হবে, ছাত্ররা দুয়ো দেবে। তবু বাড়ি ফিরে নেয়ে-খেয়ে নরহরি ইস্কুলেও গেলেন। আর যাই হোক, ফাঁসি তো আর হবে না।
যা ভয় করেছিলেন, তাই হল। ইস্কুলে পা দিতে-না-দিতেই দফতরি ফটিক এসে বলল, “হেডমাস্টারমশাই থমথমে মুখ করে আপনার জন্য বসে আছেন। ঘরে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। আপনার ফাঁসির হুকুম না হয়ে যায় আজ! যান, শিগগির যান।”