নরহরিবাবু ঘরে এসে মুড়ির বাটিটা নামিয়ে রেখে বিরস মুখে গিন্নিকে বললেন, “না, চাকরিটা গেল।”
“কেন, চাকরি গেল কেন? এই সাতসকালে কারও চাকরি যায় বলে তো শুনিনি বাপু!”
“আর সকাল-বিকেলের হিসেব করে কী হবে? চাকরিটা নেই বলেই ধরে নাও। এর পরেও কি আর কারও চাকরি থাকে?”
“কী হয়েছে সেটা বলবে তো!”
“সজনীবাবু প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, দোষের মধ্যে আমি তাঁকে কুশল প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। উনি উলটে আমাকে এমন একটা শক্ত শব্দের মানে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি হাঁ হয়ে গেলাম। চাকরিটাও তো করি ওঁরই ইস্কুলে, অভয় বিদ্যাপীঠ সজনীবাবুর বাবার নামে। উনিই সর্বেসর্বা।”
“কীসের মানে বলতে পারোনি শুনি।”
“সে আর শুনে কী করবে। জন্মেও অমন শব্দ শুনিনি। কল্যবর্ত।”
গিন্নি চোখ কপালে তুলে বললেন, “ওমা! এই সোজা শব্দটার মানে বলতে পারোনি! কলাভর্তা মানে তো কলা সেদ্ধ!”
নরহরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “কলাভর্তা নয় গো, কল্যবর্ত।” গিন্নি বললেন, “এ তো আরবি ফার্সি শব্দ বলে মনে হচ্ছে। তা অত ভেঙে পড়ার কী আছে! ডিকশনারিতে অমন শক্ত শক্ত শব্দ অনেক থাকে। সবাই কি আর সব কিছুর মানে জেনে বসে আছে? তুমি মুড়ি খাও তো৷”।
গিন্নির কথায় যুক্তি আছে বটে, কিন্তু তাতে নরহরির তাপিত হৃদয় শান্ত হল না। মুড়ি খাওয়ার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু গলা দিয়ে নামতেই চাইল না। আর নামবেই বা কী করে! জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, রাস্তার ওপাশে অলিন্দবাবু তাঁর দোতলার বারান্দা থেকে নীচে তাঁর দাদা গবাক্ষবাবুকে কী যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই বলছেন। জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে নরহরি শুনতে পেলেন, অলিন্দবাবু উত্তেজিতভাবে বলছেন, “এঃ, এই ইস্কুলে আর ছেলেটাকে পড়ানো যাবে না দেখছি। বাংলার মাস্টার যখন এমন সোজা শব্দটার অর্থ বলতে পারল না তখন ইস্কুলের অবস্থা তো বুঝতেই পারছ!”
“তা আর বলতে। শব্দটা কী যেন! ওই সময়ে একটা কাক এমন কা করে ডেকে উঠল যে, শুনতে পাইনি।”
“শোনোনি? আরে কল্যবর্ত, কল্যবর্ত।”
“অ। তা এ তো বেশ সোজা জিনিস। আমারই ভারী চেনা-চেনা ঠেকছে। মানেটা পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
“আরে কল্যবর্ত হচ্ছে এক ধরনের মর্তমান কলা। অ্যাই বড়বড় সাইজের হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকে তো কল্যবর্তের ঝাড়।”
জ্ঞানপাগলা খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, “পারেনি, পারেনি। মানে বলতে পারেনি।”
পাগলাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানী লোক থাকে। বলতে কী, পৃথিবীর অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষকে সাধারণ বিচারে পাগল বলেই মনে হয়। কার ভেতরে কী আছে বলা তো যায় না!নরহরিবাবু তাই চাপা গলায় ডাকলেন, “ওরে জ্ঞানপাগলা! ও জ্ঞানবাবাজি! একটু ইদিকে আয় তো!”
জ্ঞানপাগলা একটু বিরক্তির ভাব করল মুখে, তবে উঠেও এল। জানলার কাছে এসে বলল, “আমার কি খিদে পায় না নাকি? সেই সকাল থেকে বসে বসে কত ভাল-ভাল কথা ভাবছি, কেউ একটু ডেকে একটু জিলিপি কিংবা বোঁদে খেতে বলল না মশাই!”
নরহরিবাবু বললেন, “খাবি বাবা! এই যে, এই যে এক বাটি নারকোল মুড়ি।”
পাগলা গম্ভীর হয়ে বলল, “অন্যের এঁটোকাঁটা খাই না। আমি নয়নগড়ের রাজবাড়ির ছেলে, ভুলে গেলেন নাকি?”
“ওঃ, তাও তো বটে। তুই তো আবার রাজাগজা। তা কী খাবি বাপু বল।”
“পাঁচুর দোকানের কচুরি আর জিলিপি। দুটো টাকা ফেলুন।”
“তা না হয় দিলাম, কিন্তু কল্যবৰ্ত কথাটার অর্থ বলতে পারিস?”
ঠোঁট উলটে জ্ঞানপাগলা বলল, “সেটা আর শক্ত কী? সকালের জলখাবারকেই কল্যবর্ত বলে। দিন, টাকা দুটো দিন।”
ধুস। দুটো টাকাই জলে গেল। জ্ঞানপাগলাকে জিজ্ঞেস করাটাই আহাম্মকি হয়েছে। অত শক্ত শব্দটার কী মানেই না করল ব্যাটা। যাই হোক, দুটো টাকা গচ্চা দিয়ে নরহরি উঠে পড়লেন। বাজারে যেতে হবে।
কিন্তু বাজারে গিয়েও বিপদ। আলুওলা শ্রীদাম তাঁকে দেখেই হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “এই যে মাস্টারমশাই, শুনলুম সজনীবাবু নাকি আজ সকালে আপনার পরীক্ষা নিয়েছেন আর আপনি নাকি ফেলুস মেরেছেন।”
নরহরি প্রমাদ গুনলেন। চাকরি তো গেছেই, এবার প্রেস্টিজও গেল। কথাটা যে এত তাড়াতাড়ি চাউর হয়ে গেছে তা দেখে নরহরি তাজ্জব। আলুটা কিনেই তাড়াতাড়ি বাজার থেকে সটকাবার তালে ছিলেন নরহরিবাবু। কিন্তু হঠাৎ বিপিন উকিল এসে পথ আটকাল।
“এই যে নরহরিবাবু! শুনলুম কল্যবর্ত কথাটার মানে বলতে পারেননি! আর শক্তটা কীসের? কল্য মানে কাল, মানে আগামী কালই ধরুন। আর বর্তমানে বেঁচেবর্তে থাকা। সোজা মানেটা দাঁড়াল, যা বাজার পড়েছে, দিনকালের যা অবস্থা, তাতে আগামী কাল অবধি বর্তে থাকলেই বাঁচি। বুঝলেন?”
“যে আজ্ঞে।”
বিপিনবাবু হেঃ হেঃ করে খুব আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। তাঁর পাশে হঠাৎই আবির্ভূত হলেন যোগেনবাবু। দশাসই চেহারা, একসময়ে ব্যায়ামবীর ছিলেন। একবার প্রতিযোগিতায় মিস্টার নবাবগঞ্জ হয়েছিলেন। এখন নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্যশ্রী ব্যায়ামাগার খুলে ছেলেদের ব্যায়াম শেখান। বিপিন উকিলকে হাত দিয়ে সরিয়ে যোগেনবাবু বললেন, “ভুল শুনেছেন। ওটা হবে কলাপত্র। মানেও খুব সোজা, কলার পাতা।”
নরহরিবাবু অগাধ জলে। যে যা বলছে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? তার ওপর যোগেনবাবু ব্যায়ামবীর আর বিপিনবাবু উকিল। তিনি ঘাড় কাত করে বললেন, “যে আজ্ঞে।”