“মোহর কে খুঁজছে? তারাবাবার কি মোহরের অভাব? হাত নেড়ে মোহরের পাহাড় তৈরি করতে পারেন।”
“বটে। তা হলে কী খুঁজছিস?”
“ছুঁচ মশাই, একখানা ছুঁচ।”
“ছুঁচ! ঠিক শুনেছি তো রে! ছুঁচ?”
“ঠিকই শুনেছেন। একটা কাঁচের শিশির মধ্যে একটা ছুঁচ। তারা বাবার সেটা খুব দরকার।”
“ছুঁচ। তা ছুঁচের অভাব কী? ছেঁড়া জামাটামা সেলাই করার জন্য আমার কয়েকটা ছুঁচ আছে।”
“আরে না মশাই, যেমন-তেমন ছুঁচ নয়। এ অন্যরকম ছুঁচ।”
“কীরকম?”
“অতশত জানি না। বলেছেন, একখানা বেশ লম্বা নলের মতো শিশিতে পোরা একখানা ছুঁচ আছে। অনেকটা গুনছুঁচের মতোই।”
একগাল হেসে গবাক্ষবাবু বললেন, “গুনষ্ঠুচ খুঁজছিস সেটা বলবি তো। সেও আমার আছে। তবে শিশিটিশি নেই, সেটা তোকে জোগাড় করে নিতে হবে।”
“দুর মশাই, গুনছুঁচ হলে কি আর রাতবিরেতের মশার কামড় খেয়ে আপনার মতো কঞ্জুষের ঘরে ঢুকি! জিনিসটা মোটা ছুঁচের মতো দেখতে হলেও ঠিক ছুঁচ নয়।”
“তা হলে এই যে বললি ছুঁচ! আবার বলছিস ছুঁচ নয়?”
“না মশাই, আপনাকে বোঝানো আমার কর্ম নয়, ছুঁচের ইতিবৃত্তান্তও জানা নেই। তারাবাবা বলেছেন এই নবাবগঞ্জের কারও বাড়িতেই ছুঁচটা আছে। আমরা পাঁচজন ঘরে ঘরে ঢুকে খুঁজে হয়রান হচ্ছি। মেহনতটা জলেই গেল দেখছি।”
“তা ছুঁচটা দিয়ে তারাবাবা কী করবেন তা বলতে পারিস? চট টট সেলাই করবেন নাকি?”
“তা কে জানে! ছুঁচ দিয়ে বাণও মারতে পারেন। অতশত জানি না। খুঁজতে বলেছেন বলে খুঁজে যাচ্ছি। আপনার বাড়িতে নেই তা হলে?”
“না বাপু, অত কেরানির চুঁচ নেই আমার। খুঁজে দেখতে পারিস।”
একটা তাচ্ছিল্যের “হুঁ“ শব্দ করে পঞ্চানন জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, গবাক্ষবাবু দেখলেন। তারপর অন্ধকারেই একটু হাসলেন। ব্যাটা কাঁচা চোর। ভাল করে খুঁজলে পেয়ে যেত। জিনিসটা তেমন লুকিয়েও রাখেননি গবাক্ষবাবু। দিন পাঁচেক আগে ভোরবেলা পায়চারি করতে গিয়ে পথেই শিশিটা কুড়িয়ে পান। শিশিটিশি কাজের জিনিস ভেবে কুড়িয়ে নিয়ে দেখেন, তার মধ্যে একটা ষ্টুও রয়েছে। কাজে লাগতে পারে ভেবে সেটা এনে দেরাজে রেখে দিয়েছিলেন। ছুঁচ খুঁজতে যে চোর আসবে তা কে জানত।
গবাক্ষবাবু উঠলেন। বালিশের পাশ থেকে দেশলাই নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালালেন। জানলা বন্ধ করে সাবধানে দেরাজ খুলে দেখলেন কাঁচের শিশিটা ঠিকই আছে। কিন্তু এর জন্য যখন চোর এসেছে তখন আর অসাবধানে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। গবাক্ষবাবু জিনিসটা হাতে নিয়ে একটু ভাবলেন। তারপর বিছানার চাঁদরটা তুলে তোশকটা দেখলেন। তোশকটা তাঁর খুবই পছন্দ হল। ছেঁড়া তোশকের মধ্যে অজস্র ফুটো। তোশকের এক ধারে একখানা পছন্দসই ফুটো পেয়ে তার মধ্যে জিনিসটা ঢুকিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হলেন। রাতবিরেতে ফের ছুঁচের খোঁজে চোর এলে সুবিধে করতে পারবেনা। তাঁর ঘুম খুব সজাগ। তবে ছুঁচটার গুরুত্ব তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
২. সকালবেলাটা আজ বেশ ভালই ছিল
সকালবেলাটা আজ বেশ ভালই ছিল। দিব্যি পুবদিকে হাসি-হাসি মুখ করে সুয্যিঠাকুর উঠি-উঠি করছিলেন। উলটোদিকের বাড়ির গবাক্ষবাবু দাঁতন করতে করতে বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। আর গলাখাঁকারি দিচ্ছিলেন। পাশেই তাঁর ভাই অলিন্দবাবু নিজের দোতলা বাড়ির বারান্দায় ডনবৈঠক করছিলেন। নবাবগঞ্জে নবাগত জ্ঞানপাগলা মাথায় একটা রঙিন টুপি পরে নরহরিবাবুর বাড়ির বাইরের সিঁড়িতে বসে গম্ভীর মুখে কী যেন ভাবছিল। আর নরহরিবাবু নিজে বাইরের ঘরে বসে জুত করে তাঁর প্রিয় জলখাবার মুড়ি আর নারকেল কোরা খেতে খেতে ভারী আরাম করছিলেন।
ঠিক এই সময়ে সজনীবাবু প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন দেখে নরহরি ভদ্রতাবশে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে একগাল হেসে বলেছিলেন, “পেন্নাম হই সজনীবাবু, প্রাতর্জমণে বেরিয়েছেন বুঝি!”
সজনীবাবু খুবই রাশভারী মানুষ। কেউ কিছু বললে বা জিজ্ঞেস করলে হুঁ হাঁ দিয়ে জবাব সারেন। বেশি কথা কন না। আজ হঠাৎ কী হল কে জানে। দাঁড়িয়ে একবার অপাঙ্গে নরহরিবাবুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “ওঃ নরহরিবাবু। তা কী খবর?”
নরহরিবাবুর হাতে তখনও মুড়ির বাটি, গালের মুড়িক’টা তাড়াতাড়ি চিবোতে চিবোতে বললেন, “আজ্ঞে ভাল। খবর বেশ ভাল।”
“মুড়ি খাচ্ছেন বুঝি? বাঃ, বেশ।”
মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে এসেছেন দেখে নরহরিবাবু ভারী লজ্জা পেয়ে বললেন, “এই চাট্টি খাচ্ছিলাম আর কি!”
“বেশ, বেশ। তা আপনি তো অভয় বিদ্যাপীঠে বাংলাই পড়ান!?”
“যে আজ্ঞে।”
“আচ্ছা, কাল থেকে একটা শব্দের মানে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি বলতে পারেন কল্যবর্ত’ কথাটার মানে কী?”
বিনা মেঘে বজ্রপাত আর কাকে বলে? কল্যবর্ত শুনেই মুখের মুড়িটা বিস্বাদ ঠেকতে লাগল। ভাবলেন, কলা দিয়ে মুড়িটা মেখে খেতে বলছেন কি না। মুড়িতে কলা মেখে বেশ একটা আবর্তের সৃষ্টি করেই কি কল্যবর্ত হয়?
সজনীবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “আচ্ছা চলি।” সেই থেকে সকালটাই মাটি। সজনীবাবুর প্রশ্নটা গবাক্ষবাবু শুনতে পেয়েছেন, কারণ তাঁর দাঁতন থেমে গেছে। অলিন্দবাবুও শুনেছেন, কারণ বৈঠকি ছেড়ে তিনি রেলিঙের ওপর দিয়ে বুকে নরহরিবাবুর দুর্দশা দেখছেন। শুধু জ্ঞানপাগলাই যা নির্বিকার।