রোগা চেহারার একটা লোক তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “ও আপনার কর্ম নয় বাবাজি। এ জঙ্গল ঘোর গোলকধাঁধা। পথ আমিই দেখাচ্ছি। দিনমানে তারাবাবা গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন। সে জায়গা আমরা কয়েকজন মাত্র চিনি।”
শ্যামা হেঁকে উঠে বলল, “খবর্দার, ওকে বাবা-টাবা বলবি না।”
“যে আজ্ঞে।”
“তুই কে?” লোকটা বলল, “আজ্ঞে প্রিয়ংবদ। কেউ কেউ পঞ্চাও বলে। আসুন।”
পঞ্চা গহিন থেকে গহিনতর জঙ্গলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। গাছ আর লতাপাতার জড়াজড়ির মধ্যেও একটা সংকীর্ণ শুড়িপথ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছিল। পেছনে বিস্তর লোক কথা কইছে। পঞ্চা বলল, “কর্তারা কথা কইবেন না। বাবার ধ্যান ভেঙে গেলে কুপিত হবেন।”
শ্যামা ধমক দিল, “ফের বাবা?”
“আজ্ঞে আর হবে না।”
পঞ্চা যেখানে নিয়ে এল সেটা ঘোর জঙ্গলের মধ্যে একটু পরিষ্কার জায়গা। তবে ওপরে বড় বড় গাছের ডালপালায় বেশ অন্ধকার। সামনে নরকরোটি দিয়ে তৈরি একখানা ঘর। অনেকটা তাঁবুর মতো দেখতে। ঢোকার দরজার পাল্লা বন্ধ। পঞ্চা বলল, “ওই হল বাবার সাধনগৃহ।”
শ্যামা তাকে এবার শুলের খোঁচা দিয়ে চাপা গলায় বলল, “ফের বাবা বললে এ-ফোঁড় ওফোড় করে দেব।”
সবাই ঘরটার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
জ্ঞান এগিয়ে এসে হাত তুলে সবাইকে শান্ত থাকতে ইঙ্গিত করল। চাপা গলায় বলল, “এটা আমার লড়াই। আমি নয়নগড়ের যুবরাজ জ্ঞান, বিদ্রোহ দমনের জন্য আমি মহারাজ প্রণন্দের পাঞ্জা নিয়ে এসেছি।”
সবাই অবাক চোখে চেয়ে রইল। ভিড় ছেড়ে কয়েকজন লোক এগিয়ে গিয়ে জ্ঞানের পাশে দাঁড়াল। তারা কিছুই করল না, শুধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ঘরটার দিকে চেয়ে রইল। তেজেনবাবু মৃদুস্বরে নরহরিকে বললেন, “ওরা বোধ হয় ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করছে।”
হঠাৎ একটা করোটি ঘরের মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল। তারপর আরও একটা। আরও একটা। তারপর হঠাৎ হুড়মুড় করে গোটা ঘরটাই ধসে পড়ে গেল। করোটি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। আর সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে পাঁচটা বিশাল চেহারার ভয়ংকর লোক উঠে দাঁড়াল।
“কে! কে তোরা! এত সাহস! ধ্যান ভাঙলি।”
জ্ঞান অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, “বিদ্রোহী মাজুম, রাজা প্রণন্দের নামে আমি তোমাকে ও তোমার সঙ্গীদের নির্বাসন দণ্ড ঘোষণা করছি।”
সঙ্গে সঙ্গে মাজুমের মুখ যেন রাগে ফুলে দুনো হয়ে গেল। সে হিসহিস করে বলল, “ওঃ তুমি! তুমি যুবরাজ জ্ঞান! আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছ কাপুরুষ!”
বলেই জ্ঞানের গলার শব্দের নিশানা তাক করে সে তেড়ে এল। হাতে খঙ্গ। জ্ঞান সরে গেল বিদ্যুৎগতিতে। তারপর আর হিতাহিতজ্ঞান রইল না মাজুম আর তার স্যাঙাতদের। তারা চারদিকে অন্ধের মতো খঙ্গ চালাতে লাগল। খচাং খচাং করে চারদিকে গাছের ডালপালা কেটে পড়তে লাগল। সভয়ে লোকেরা দূরে সরে গাছগাছালির আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখতে লাগল।
যুদ্ধ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। হঠাৎ একটা মোটা গাছের আড়াল থেকে সজনীবাবু বেরিয়ে এসে হাতের মোটা বেতের লাঠির বাঁকানো হাতলটা মাজুমের পায়ে ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টান মারতেই সে পাহাড়ের মতো পড়ে গেল মাটিতে। জ্ঞান বিদ্যুৎগতিতে গিয়ে তার কোমরে হাত দিয়ে দুটো কাঁচের শিশি বের করে নিল।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মাজুম। বলল, “কুমার, এটা অন্যায় হচ্ছে। আমার জান ফিরিয়ে দাও। কাপুরুষের মতো কাজ কোরো না।”
“এটা তোমার কাপুরুষতার জবাব। মাজুম, শান্ত হও। মাথা পেতে দণ্ডাজ্ঞা গ্রহণ করো। নয়নগড়ে তোমাদের আর স্থান নেই। খঙ্গ ফেলে দাও মাজুম, শান্ত হও। তোমাদের এই পৃথিবীতেই বাস করতে হবে। বন্ধুভাবে।”
জ্ঞান সজনীবাবুর দিকে ফিরে বলল, “আপনি সাহসী। অনেক ধন্যবাদ। এবার আমরা চলে যাব।”
জ্ঞান ও তার সঙ্গীরা পাশাপাশি দাঁড়াল। স্থির। জ্ঞান একটা শিশি শূন্যে তুলে কিছুক্ষণ ধরে রইল। তারপর হাতটা সরিয়ে নিল ম্যাজিশিয়ানের মতো। আশ্চর্য! শিশিটা পড়ল না। শুন্যে একটা ঘড়ির কাঁটার মতো ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল। ঠিক এক মিনিটের মাথায় ধীরে ধীরে আবছা হতে লাগল তারা। জ্ঞান হাত তুলে বলল, “বিদায়।” পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। সবাই থ’ হয়ে দৃশ্যটা দেখল।
মাজুম ও তার সঙ্গীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সজনীবাবু হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বললেন, “ওহে মাজুম, নবাবগঞ্জে থাকতে চাও? তা শত্রু হিসেবে, না বন্ধু হিসেবে?”
মাজুম খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে খড়গটা ফেলে দিল। তারপর দু’হাত ওপরে তুলে স্খলিত কণ্ঠে বলল, “বন্ধু! বন্ধু!”
শ্যামা তান্ত্রিক একগাল হেসে সজনীবাবুকে বলল, “ভাববেন না। ব্যাটাদের আমি আমার চেলা করে নেব’খন।”