গবাক্ষবাবু ভিরমি খেতে-খেতেও দেখলেন জ্ঞানপাগলা ছুটে আসছে। কিন্তু জাম্বুবানটা তাকেও ডল পুতুলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তীরবেগে এগোতে লাগল আর বলতে লাগল, “পথ দেখা! পথ দেখা!”
চিঁ চিঁ করতে করতে প্রাণভয়ে গবাক্ষবাবু পথ দেখাতেও লাগলেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী হচ্ছে, তা বুঝতে পারলেন না। অন্ধকারে তিনিও যে পথ ভাল দেখতে পাচ্ছেন তা নয়। আন্দাজে আন্দাজে বলছেন, “সোজা চলুন। সোজা। মাইলটাক গিয়ে বাঁয়ে কাঁচা রাস্তা। তারপর …”
জটেশ্বরের জঙ্গল অন্তত মাইলতিনেক পথ। কিন্তু জাম্বুবানটা যেন হাওয়ায় ভর করে লহমায় চলে এল। তারপর গাছপালা ভেঙে তছনছ করতে করতে জঙ্গলে ঢুকতে লাগল। লোকটার গায়ে যেমন জোর, তেমনই সহ্যশক্তি। কিন্তু গবাক্ষবাবু তো তা নন। জঙ্গলের ডালপালার খোঁচায় তাঁর শরীর ছড়ে যেতে লাগল, শপাং শপাং করে ডালপালা চাবুকের মতো পড়ছিল সারা গায়ে। গবাক্ষ আধমরা হয়ে গোঁ গোঁ করছিলেন।
একটা সময়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থামল নোকটা। তাঁকে ছুঁড়ে জলকাদায় ফেলে দিয়ে বলল, “দে, টর্চটা দে।”
টর্চটা যে হাতে আছে তা ভুলেই গিয়েছিলেন গবাক্ষবাবু। কোনওরকমে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে! নিন।”
লোকটা নিতে পারছিল না। অন্ধের মতো শুন্যে হাতড়াচ্ছিল। হঠাৎ বিদ্যুতের মতো মাথায় একটা কথা খেলে গেল তাঁর। লোকটা চোখে দেখতে পাচ্ছে না। এমন সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না।
লোকটা হিংস্র গলায় বলল, “পালানোর মতলব করছিস! পালাবি?”
বলেই লোকটা খঙ্গের মতো কী একটা জিনিস কোমর থেকে খুলে আনল।
কোপটা যেখানে পড়ল সেখানে গবাক্ষবাবুর পা। তিনি সট করে পা দুটো টেনে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে তফাত হলেন খানিকটা।
“কোথায় তুই?”
গবাক্ষ জবাব দিলেন না। কিন্তু বোধ হয় তাঁর শ্বাসের শব্দে টের পেয়ে লোকটা এগিয়ে আসছিল। কী হল কে জানে, গবাক্ষ টর্চটা তুলে সুইচ টিপে ধরলেন।
কেলোর দোকানের শস্তার টর্চ। কখন জ্বলে, কখন জ্বলে না তার কিছু ঠিক নেই।
কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে টর্চটা ধাঁ করে জ্বলে উঠল। আর সোজা ফোকাসটা গিয়ে পড়ল জাম্বুবানটার চোখে। লোকটা খঙ্গ ফেলে দিয়ে চোখ চেপে ‘আ’ করে একটা আর্তনাদ করল।
গবাক্ষবাবু আরও খানিকটা সরে এলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। ভয়ে মরে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু মনে হল টর্চটা থাকলে বোধ হয় বেঁচে যাবেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, টর্চের মতো গুরুতর জিনিস আর দুনিয়ায় নেই। কলকারখানায় সব জিনিস ফেলে শুধু টর্চ তৈরি করা উচিত।
আচমকাই গবাক্ষ শুনতে পেলেন জঙ্গল ভেঙে বাঁদিক থেকে কারা যেন আসছে। জাম্বুবানটার দলবল নাকি? গবাক্ষবাবু তাড়াতাড়ি ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে সরে গেলেন।
চার-পাঁচটা বিশাল চেহারার লোক এসে জাম্বুবানটাকে ঘিরে দাঁড়াল।
কোন ভাষায় যে তারা কথা কইল একবর্ণও বুঝতে পারলেন না গবাক্ষ। কিন্তু তিনি টর্চটা বাগিয়ে ধরে রইলেন।
অন্ধ জাম্বুবানটা কী যেন বলতেই লোকগুলো চটপট চোখে কী যেন পরে নিল। তারপর সোজা এগিয়ে এল তাঁর দিকে।
পট করে টর্চ জ্বালালেন গবাক্ষ। টর্চ জ্বলল বটে, চোখে আলোও গিয়ে পড়ল, কিন্তু ঠুলির মতো কী একটা বস্তু চোখে পরে নেওয়ার ফলে এদের কিছু হল না।
গবাক্ষ আর দেরি করলেন না। পিছু ফিরে ছুটতে লাগলেন। পেছনে লোকগুলো তেড়ে আসছে।
আচমকাই যেন চোখের জ্যোতি বেড়ে গেল গবাক্ষর। তিনি জঙ্গলটা বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। দিব্যি গাছের ফাঁকে ফাঁকে আঁকাবাঁকা হয়ে পথ করে নিচ্ছিলেন তিনি।
খানিকক্ষণ ছোটার পর মনে হল, পেছনে কেউ আসছে না তো! তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে বেদম হয়ে পড়েছেন। না জিরোলেই নয়। একটা গাছে হেলান দিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ বাদে একটা গণ্ডগোল, অনেক লোকের কথাবার্তা আর চেঁচামেচি কানে এল তাঁর। না, এরা জাম্বুবান নয় বোধ হয়। চোখ খুলে তিনি দেখলেন, এতক্ষণ তাঁর খেয়ালই হয়নি যে, ভোরের আলো ফুটেছে। সেইজন্যই জঙ্গলটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন একটু আগে।
কে যেন চেঁচিয়ে ডাকছিল, “গবাক্ষবাবু। গবাক্ষবাবু!” গবাক্ষ সজনীবাবুর গলা চিনতে পেরে সোল্লাসে চেঁচিয়ে বললেন, “এই যে আমি!”
কিন্তু গলা দিয়ে এমন ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজ বেরোল যে তিনি নিজেই তা শুনতে পেলেন না। তবে তিনি এগিয়ে গেলেন। ছুটতে ছুটতে তিনি জঙ্গলের ধারেই চলে এসেছিলেন কখন যেন। একটু এগোতেই দেখেন সজনীবাবুর পিছু পিছু জ্ঞানপাগলা, নরহরি, অলিন্দ, নৃপেনবাবু, তেজেনবাবু, আরও অনেকে দল বেঁধে হাজির।
সজনীবাবু তাঁকে দু’হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, “বেঁচে আছেন তা হলে! অ্যাঁ। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”
কাতরকণ্ঠে গবাক্ষবাবু বললেন, “আর কয়েকবার ঝাঁকুনি দিলে বেঁচে থাকব না কিন্তু। জাম্বুবানটা আমাকে আধমরা করে রেখেছে।”
সজনীবাবু তাঁকে আরও দুটো ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে বললেন, “সেই লোকটা কোথায়?”
গবাক্ষবাবু সভয়ে বললেন, “জঙ্গলের মধ্যে।”
ভিড়ের পেছন থেকে ‘জয় কালী’ বলে এগিয়ে এল শ্যামা তান্ত্রিক। পরনে রক্তাম্বর, হাতে শূল। বলল, “কাল মাঝরাতে ব্যাটাকে বাণ মেরে কানা করে দিয়েছিলাম। এবার ব্যাটার মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলব। বলে কিনা তান্ত্রিক! তন্ত্রের জানে কী ব্যাটা তারা তান্ত্রিক? আসুন আপনারা আমার পিছু পিছু। ব্যাটাকে আমি ঠিক খুঁজে বার করব।”