“গবাক্ষবাবুর ঘরে যখন জান-এর আলো দেখতে পেলাম তখনই বুঝলাম গবাক্ষবাবুর বিপদ আছে। মাজুম যেখানেই থাকুক, জান এর আলো সে দেখতে পাবেই।”
“জান! জানটা কী জিনিস?”
“ওই ছুঁচটার নাম। নয়নগড়ের একজন মানুষ ছিলেন জান। তিনিই সময়ের এই কাঁটাটি আবিষ্কার করেন।”
“সময়ের কাঁটা! আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না বাপু।”
“বুঝবে না। ওটাই আমার নয়নগড়ে ফেরার চাবি।”
“নয়নগড়টা কোথায় বাপু?”
“এইখানেই। মাইলখানেকের মধ্যেই।”
“তা হলে যেতে বাধা কী?”
“তুমি জানো কাছাকাছি নয়নগড় বলে একটা জায়গা আছে?”
“না তো!”
“কেন জানো না তা জানো? আসলে নয়নগড় এখানেই আছে, কিন্তু ভিন্ন কম্পাঙ্কে।”
“ও বাবা! মাথা যে ঝিমঝিম করছে।”
“পৃথিবীটা খুব বিচিত্র।”
“তুমি কি সত্যিই পাগল?”
“আমার কথা বুঝতে না পারলে লোকে তো পাগলই ভাববে। গালিলেওকে কি তোমরা পাগল ভাবোনি!”
“তা বটে!”
“আমি সোজা করে তোমাকে একটু বুঝিয়ে দিচ্ছি। একটা রেডিয়ো বা টিভি সেটে যেমন অনেক চ্যানেল থাকে, পৃথিবীটাও তেমনই। এর এক-এক চ্যানেলে এক-এক জীবন, এক-এক সমাজ। কেউ কারও মতো নয়। আমরা যেনয়নগড়ে থাকি তোমরা তা কখনও খুঁজে পাবে না, অথচ তা এখানেই আছে।”
রুমাল বের করে সজনীবাবু কপালের ঘাম মুছে বললেন, “ও সব শুনে আমার মাথা ঘুরছে। গবাক্ষর কথাটা শেষ করো।”
“গবাক্ষবাবুর ঘরে জানের আলো জ্বলে উঠতেই মাজুম জটেশ্বরের জঙ্গল থেকে ছুটে চলে আসে।”
“অতদুর থেকে?”
“সে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে দৌড়তে পারে।”
“ও বাবা!”
“সে এসে হাজির হল এবং বুঝতে পারল জান এখানেই আছে। সে তখনই আমার উপস্থিতি টের পায় এবং আমি পালাই। সে কিছুদুর আমাকে তাড়া করে ফিরে আসে। আমিও ফিরি। সে গবাক্ষবাবুর ঘরে ঢোকে। ঢুকে গবাক্ষবাবুকে হিংস্র চাপা গলায় বলে, ছুঁচটা দে। নইলে মেরে ফেলব। গবাক্ষবাবু ভয় পেয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু ঠিক এই সময় লক্ষ্মীকান্ত এসে ঘরে ঢোকে আর ছুঁচটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পারবে কেন? মাজুম তাকে মেরে শুইয়ে দেয়।”
“সে কি মরে গেছে?”
“না। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি ঘরে ঢুকে দেখে এসেছি। লক্ষ্মীকান্তর খাস চলছে।”
“বাঁচা গেল। তারপর?”
“এই সময়ে গবাক্ষবাবু একটা ভুল করেন। অবশ্য না জেনে। তাঁর হাতে একটা টর্চ ছিল। হঠাৎ তিনি টর্চটা জ্বেলে ফেলেন। আর আলোটা গিয়ে সোজা মাজুমের চোখে পড়ে। চোখে আলো পড়লেই মাজুমের সর্বনাশ। সে সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। গবাক্ষবাবু আলো জ্বালাতেই মাজুম খেপে যায়। বরাবরই সে ওইরকম। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। সে প্রথমে অন্ধের মতো টর্চটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সেটা না পেয়ে সে গবাক্ষবাবুকেই জাপটে ধরে।”
“কেন?”
“পথ দেখানোর জন্য। বলেছি না সে চোখে আলো পড়লে অন্ধ হয়ে যায়? তখন কে তাকে পথ দেখাবে?”
“তুমি কিছু করলে না?”
“হ্যাঁ। আমি সেই সুযোগে একবার চেষ্টা করেছিলাম তার কাছ থেকে জান কেড়ে নিতে। কিন্তু মাজুমের গায়ে এমনিতেই সাতটা হাতির মতো জোর। তার ওপর সে তখন খেপে আছে। একটা ঝটকায় আমাকে দশ হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে চলে যায়।”
সজনীবাবু বললেন, “তোমার গল্পটা রূপকথার মতো। তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। শোনো বাপু, তোমার জানের ব্যাপারে আমারও কিছু অপরাধ আছে। ওটা আমিও দখল করার চেষ্টা করেছিলাম।”
“অনেকেই করবে। জান এক আশ্চর্য জিনিস। সঠিক প্রয়োগ করলে সে তোমাকে ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পনে নিয়ে যেতে পারে।”
“না বাপু, ওসব নয়। আমি ভেবেছিলুম, একটা আশ্চর্য আলো ঠাকুরঘরে জ্বালিয়ে রাখব।”
“হ্যাঁ, জানের আলো আশ্চর্য আলো। জ্বালিয়ে রাখলে কয়েক হাজার বছর ধরে জ্বলবে।”
“বলো কী।”
“জান একটি ধাতব জিনিস। তোমরা সেই ধাতুর সন্ধান জানো। অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই তা আলো দিতে থাকে।”
‘তুমি সত্যিই নয়নগড়ের রাজপুত্র?”
“হ্যাঁ। আমি যুবরাজ।”
“আর ওই মাজুম?”
“সে আমার শত্রু। সে আমাকে নয়নগড়ে ফিরে যেতে দেবে না। সেইজন্যই সে জান কেড়ে নিয়ে গেছে।”
“তাতে তার কী লাভ?”
“সে তুমি বুঝবে না। নয়নগড়ে রাত আর দিনের মধ্যেই একটা সংঘর্ষের ব্যাপার আছে। মাজুম এবং তার লোকেরা চায় আমার বাবা দিনের বেলা রাজত্ব করুক, কিন্তু সন্ধের পর থেকে ভোর অবধি রাজত্ব করবে ওই মাজুম। এই প্রস্তাব আমার বাবা মানেননি। তাই একটা লড়াই চলছে। আমাকে তোমাদের কম্পাঙ্কে নির্বাসন দিতে পারলে মাজুম নিষ্কণ্টক হবে। আমার অসহায় বুড়ো বাবা তাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হবেন। কারণ মাজুমরা সংখ্যায় বেশি, তাদের গায়ের এবং অস্ত্রের জোরও বেশি। শুধু দিনের বেলা অন্ধ হয়ে যায় বলে তারা খানিকটা দুর্বল।”
“এখানে যারা নয়নগড়ের লোক বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা কোন দলের?”
“কিছু আমার দলের, কিছু মাজুমের।”
“এখন আমরা কী করব?”
বিষণ্ণ গলায় জ্ঞানপাগলা বলল, “কিছুই করার নেই। বোধ হয় আমি হেরেই গেলাম।”
৫. কার পাল্লায় পড়েছেন
কার পাল্লায় পড়েছেন তা আদপেই বুঝতে পারছেন না গবাক্ষবাবু। লোকটা তাকে বগলে চেপে হেঁচড়ে নিয়ে চলেছে। এরকম ভয়ংকর গায়ের জোর যে কোনও মানুষের থাকতে পারে তা গবাক্ষবাবুর জানা ছিল না। অপরাধটা কী করেছেন তাও ভেবে পাচ্ছেন না। মাঝরাতে লোকটা হঠাৎ ঘরে ঢুকে যখন বলল, ছুঁচটা দে–তখন তার ভয়ংকর রক্তাম্বর পরা বিশাল চেহারা আর জ্বলন্ত চোখ দেখে দ্বিরুক্তি না করে ছুঁচটা দিয়ে দেন গবাক্ষবাবু। একটা আহাম্মক লোক হঠাৎ কোথা থেকে ঘরে ঢুকে লোকটার সঙ্গে হাতাহাতি করতে গেল। চোখের পলকে লোকটাকে মেরে রক্তাক্ত করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিল জাম্বুবানটা। সেই সময়ে হঠাৎ হাত পা কেঁপে কেঁপে গবাক্ষবাবুর যখন দাঁতকপাটি লাগার অবস্থা তখনই তাঁর হাতের টর্চটা আচমকা জ্বলে ওঠে। জাম্বুবানটা একটা চিৎকার করে চোখ ঢেকে ফেলল। তারপরই হাত বাড়িয়ে তাকে চেপে ধরে হিঁচড়ে বাইরে এনে বলল, “পথ দেখা। জটেশ্বর জঙ্গলে যাওয়ার পথ দেখা।”