“সেরকমই তো বলল যেন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সজনীবাবু বললেন, “কী চায় এরা?”
“আমাদের ভাত মারতে চায়, আর কী চাইবে?”
সজনীবাবু পেছন ফিরে টর্চ জ্বেলে পথটা দেখলেন। চারজনের কাউকেই দেখা গেল না। সজনীবাবু চিন্তিত মুখে বললেন, “আমার দরোয়ান আর পাইকদের একটু হুঁশিয়ার করে দিয়ে আয় তো। ব্যাপারটা আমার সুবিধের ঠেকছে না। যা, দুটো টাকা দেব’খন।”
“যে আজ্ঞে। তবে দু’ টাকায় আজকাল এক পো চালও হয় না কর্তা।”
“যা, পাঁচ টাকাই পাবি।”
“তা হলে চালের সঙ্গে ডালটা হল। কিন্তু বাঙালির যে একটু আঁশটে গন্ধও লাগে কর্তামশাই, না হয় পুঁটিমাছের দামটাই দিলেন।”
“অ। তুই তো ঘঘাড়েল দেখছি। আচ্ছা, দশ টাকাই দেব।”
“ওঃ, অনেকটা ওপরে উঠেছেন কর্তা। আর দু’ ধাপ উঠলে ওইসঙ্গে একটু নুন-লঙ্কাও হয়ে যায়।”
“দু’ ধাপ বলতে?”
“দুটো টাকা মাত্র। ও আপনি টেরও পাবেন না। পানের পিক ফেলার মতো, নাকের সিকনি ঝাড়ার মতো ফেলে দিলেই হবে।”
“হাতি কাদায় পড়লে চামচিকেও লাথি মারে দেখছি।”
“আজ্ঞে, চামচিকের তো ওইটাই মওকা কিনা। তাকেও তো হাতযশ দেখাতে হয়।”
“হুম। তুই বুদ্ধি রাখিস বটে! আচ্ছা যা, বারো টাকাই দেব।”
“তা হলে আগাম ফেলুন, দৌড়ে যাই।”
পকেট থেকে টাকা বার করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, “কিন্তু কাজটা ঠিকমতো করিস, নইলে কালই পাইক পাঠিয়ে ধরে আনব।”
“প্রাণটা তো আপনার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে।”
শ্রীদাম দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর সজনীবাবু খুব জোর পায়ে হেঁটে গবাক্ষর বাড়ি অবধি পৌঁছে গেলেন। চারদিক নিঝঝুম। কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। টর্চ জ্বেলে দেখলেন, নরহরি মাস্টারের বারান্দায় পাগলাটাকে দেখা যাচ্ছে না। টর্চের আলো যতদূর যায়, জনমনিষ্যি নেই।
লক্ষ্মীকান্ত কি কাজ সেরে চলে গেছে? কিন্তু গবাক্ষর ঘরের দরজা বন্ধ। কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে মনেই হচ্ছে না।
তিনি ধীরে ধীরে গবাক্ষবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজাটা ঠেলে দেখলেন, ভেতর থেকে বন্ধ। জানলাগুলোও খোলা নেই।
দরজায় টোকা দিয়ে তিনি মৃদুস্বরে ডাকলেন, “গবাক্ষবাবু, ও গবাক্ষবাবু।”
কেউ সাড়া দিল না। সজনীবাবু ঘড়ি দেখেলেন। তিনটে বাজে। এই সময়ে যদি কেউ তাঁকে এখানে দেখে ফেলে তবে সন্দেহ করতে পারে। এ তো ঠিক প্রাতভ্রমণের সময় নয়।
কিন্তু কাজটাও জরুরি। জিনিসটা উদ্ধার হল কি না তা হলে জানাটাও ভীষণ দরকার। অগত্যা সজনীবাবু ঘরের জানলাগুলো বাইরে থেকে ঠেলেঠুলে দেখতে লাগলেন।
পুবদিকের জানলাটা ঠেলতেই খুলে গেল। সজনীবাবু ভেতরে টর্চ ফেলে দেখলেন, গবাক্ষ চাঁদরমুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তিনি চাপা স্বরে ‘গবাক্ষবাবু, গবাক্ষবাবু’ বলে দু’বার ডাকলেন।
তারপরই তাঁর হঠাৎ নজরে পড়ল গবাক্ষবাবুর গায়ে যে চাঁদরটা চাপা দেওয়া রয়েছে তাতে যে লাল রঙের ছোপগুলোকে তিনি চাঁদরের নকশা বলে প্রথমে ভেবেছিলেন তা আসলে রক্তের দাগ। জিনিসটা যে রক্তই তা আরও ভাল করে বুঝলেন মেঝেতে আলো ফেলে। সেখানেই খানিকটা রক্ত পড়ে জমাট বেঁধে আছে।
সর্বনাশ! শেষে লক্ষ্মীকান্ত কি গবাক্ষকে খুন করে গেল নাকি? তো ঘটনা অনেকদূর গড়াবে। অকুস্থলে ধরা পড়লে তাঁরও বিপদ। সজনীবাবু টর্চটা নিভিয়ে তাড়াতাড়ি স্থানত্যাগের জন্য পা বাড়াতেই ফের বিপদ।
পাশের দোতলা বাড়ির ওপরের বারান্দা থেকে গবাক্ষর ভাই অলিন্দ গদগদ স্বরে বলে উঠল, “সজনীখুড়ো যে। তা আজ কি দাদাকে শব্দার্থ জিজ্ঞেস করতে এসেছেন? খুব ভাল। বেশ কঠিন দেখে শব্দ বেছে এনেছেন তো! একেবারে গুতুলের মতো হওয়া চাই কিন্তু। ঠঙাত করে গিয়ে মাথায় লাগবে আর সঙ্গে সঙ্গে কুপোকাত। ওঃ, কাল নরহরিবাবুকে একখানা যা ঝেড়ে গেছেন, যেন আধলা ইট।”
সজনীবাবু পালানোর মতো মূর্খামি করলেন না। অলিন্দ তাঁকে দেখে ফেলেছে, এখন পালালে সন্দেহ করবে। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখাই হল বুদ্ধিমানের মতো লক্ষণ।
তিনি খুব ভালমানুষের মতো বললেন, “তা তুমি আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছ বুঝি।”
“না খুড়ো, মাঝরাতে ওঠার অভ্যাস নেই। কিন্তু নবাবগঞ্জের যা অবস্থার অবনতি হচ্ছে তাতে ঘুমোয় কার সাধ্যি! রাত হতে-না-হতেই চোর-ছ্যাঁচড়ের যেন হাট বসে যায়। এই কেউ দৌড়ে গেল, এই কেউ দরজায় ঠকাত করে শব্দ করল, এই কেউ ফিসফিস করে কারও সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে লাগল। আড়াইটে পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করে এই বারান্দায় এসে একটু হাওয়া খাচ্ছি। আপনারও কি সেই অবস্থা?”
“আর বলল কেন, একটু আগেই চোর ঢুকেছিল বাড়িতে। শুনছি নয়নগড় না কোথা থেকে একদল খুনে গুণ্ডা আর লুঠেরা নবাবগঞ্জে ঢুকে পড়েছে। তা আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। তাই ঘুরে ঘুরে চেনাজানা লোকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।”
“তা হলে তো খুব ভয়ের কথা হল খুড়ো। সেইজন্যেই আজকাল রাতবিরেতে উৎপাত বেড়েছে। তা নয়নগড় জায়গাটা কোথায়?”
“জানি না। লোকমুখে শোনা কথা।”
“সেই জায়গাটা কি বদমাশদের বীজতলা?”
“তাই তো মনে হয়।”
“আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান, জ্ঞানপাগলা যেন কোথাকার রাজপুত্তুর! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো নয়নগড়ের রাজপুত্তুরই তো বলে নিজেকে।”
সজনীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “সাবধানে থেকো। কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কে কোন ভেক ধরে আসছে তার ঠিক কী?”