লোকটা অবাক হয়ে বলে, “বলেন কী বাবা। তেল না দিলে কি মেশিন চলে? তাও তেল আর দিতে পারি কই? অত পাইক বরকন্দাজ পেরিয়ে দেউড়িতে ঢুকতে পারলে তো! আর ঢুকলেই কি সুবিধে হবে? ভেতরে মোড়ল মুরুব্বিরা যে রাজাবাবাকে একেবারে ভেঁকে ধরে বসে থাকে। যেন পাকা কাঁঠালে ভোমা মাছি। তা প্রাতঃকৃত্যে বেরিয়েছেন নাকি বাবা?”
“না হে বাপু, প্রাতর্ভ্রমণে।”
“ওই একই হল। যার নাম চালভাজা তারই নাম মুড়ি।”
লোকটার দিকে আর ভ্রুক্ষেপ না করে সজনীবাবু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন।
“রামজিকি কৃপা। আরে ই তো সোজোনীবাবু আছে। রাম রাম সোজোনীবাবু, শরীর দেমাক সব তন্দুরস্ত আছে তো?”
এ-পর্যন্ত যেক’টা লোকের দেখা পেয়েছেন তাদের একজনকেও সজনীবাবু চেনেন না। নবাবগঞ্জ ছোট জায়গা, এখানে সবাইকে সবাই চেনে। সজনীবাবুও চেনেন। কিন্তু এ লোকগুলোকে চেনা ঠেকছে
কেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। আসলে যে মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তার মাথায় বিড়ের মতো একটা পাগড়ি গোছের, গায়ে গলাবন্ধ কোট, পরনে ধুতি। খুবই বশংবদের মতো হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে।
সজনীবাবু লোকটিকে কাটানোর জন্য বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব ভাল।”
“রামজিকি কৃপা, লেকিন হুজুর, কলিযুগ কি খতম হয়ে গেলো নাকি?”
‘কেন বলুন তো?”
“আমি তো ভাবছিলাম কি, কলিযুগ খতম হোতে আউর ভি দু-চার বরষ লাগবে। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কলিযুগ সায়দ খতম হোয়েই গিয়েছে।”
সজনীবাবু ক্রমশ চটছেন। এবার খ্যাঁক করে উঠলেন, “আমার সঙ্গে কলিযুগের সম্পর্ক কী মশাই?”
“আমার বুঢ়া দাদাজি বলত, বুঢ়া দাদাজি সমঝলেন তো? হামার পিতাজি কি পিতাজি, বুঝলেন?”
“বুঝলাম।”
“তো বুঢ়া দাদাজি কহতা থা কি, কলিযুগ যখন খতম হোবে তখন রাত মে দিন হোবে আউর দিন মে রাত। উস লিয়ে বলছিলাম কি সোজোনীবাবু, এখুন কি দিন না রাত। আপনি তো সবেরকা ঘুমনা শুরু কর দিয়া। তাই ভাবলাম, সোজোনীবাবু পণ্ডিত লোক আছে, কলিযুগ খতম হলে উনি ঠিক টের পাবেন।”
সজনীবাবু লোকটার দিকে কটমট করে একবার চেয়ে বললেন, “হুম। যত্তসব।”
বলে আবার জোর কদমে হাঁটতে লাগলেন। না, আর কোনও উদ্ভট লোকের উদয় হল না। তবে মোড়ের কাছ বরাবর যখন। এসেছেন তখন পাশের ঝোঁপের আড়াল থেকে কে যেন মৃদুস্বরে চাপা গলায় ডাকল, “একটা কথা ছিল কর্তা।”
সজনীবাবু বিরক্তিকর সঙ্গে বললেন, “আমার সময় নেই।”
“আমি ওদের দলের লোক নই।”
“তুমি কে?”
একজন মাঝারি মাপের মানুষ ঝোঁপের আড়াল থেকে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে এল। গায়ে গেঞ্জি, পরনে হেঁটো ধুতি, চোখে-মুখে একটু ভয়-ভয় ভাব। হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমি শ্রীদাম।”
এই প্রথম একটা লোককে চেনা ঠেকল সজনীবাবুর। এ লোকটা তাঁর বাগান পরিষ্কার করেছিল গত বছর। বিরক্তির সঙ্গে সজনীবাবু বললেন, “তুই আবার কী চাস? একটা কাজে যাচ্ছি, পদে পদে বাধা পড়ছে।”
“আজ্ঞে, কর্তা, আমাদের ওপর বড় অবিচার হচ্ছে।”
“অবিচার। কীরকম অবিচার?”
“আমরা ভুমিপুত্তুর কিনা বলুন।”
“ভূমিপুত্তর। সে আবার কী রে?”
“আজ্ঞে, এটাই আমাদের জন্মভূমি বটে তো! নবাবগঞ্জেই তো জন্মে ইস্তক এত বড়টি হলাম। তাকেই তো বলে ভূমিপুত্তুর।”
“ভূমিপুত্র নাকি। হ্যাঁ, কথাটা শুনেছি বটে। সন অব দ্য সয়েল।”
“আজ্ঞে, ইংরিজিতে তাই বলে বটে। সং অব্দি সয় লো। তা এই ভূমিপুত্তুরেরও উপায় নেই?”
“তা থাকবে না কেন?”
“আজ্ঞে, সেইটেই তো সমস্যা দাঁড়াচ্ছে। সারাদিন খেটেখুটে যা জোটে তাতে পেট চলে না। তাই রাতের দিকে দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করতে বেরোতে হয়। সত্যি কথাটা কবুল করলাম বলে অপরাধ নেবেন না কর্তা।”
“হুম। তা সমস্যাটা কোথায়?”
“কিন্তু পয়সা রোজগারের কি জো আছে? কোথা থেকে উটকো সব লোক এসে নবাবগঞ্জ ভরে ফেলল। রাতবিরেতে পথেঘাটে যত্রযত্র তাঁরা দাঁত বের করে দেখা দিচ্ছে।”
“বটে!”
“পরশুদিন হরিপদ সরখেলের বুড়ি পিসির সোনার হারখানা হাতাব বলে খিড়কির দরজাটা সবে আলগা করেছি, অমনই এক ছোঁকরা এসে হাজির। বলে কী, এঃ হেঃ, দরজা কি ওরকম আনাড়ির মতো খুলতে হয়? দেখি তোমার যন্ত্রপাতি। ইস, এইসব মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি নিয়ে তোমরা চুরি করতে বেরোও নাকি? তোমরা খুবই পিছিয়ে আছ হে। এই আধুনিক পৃথিবীতে কত নতুন নতুন যন্ত্র তৈরি হয়েছে। তোমরা কি একটু বিজ্ঞান-টিজ্ঞানও পড়ো
নাকি…বলে সে কী লেকচার। যেন ইস্কুলের ক্লাস নিচ্ছে। চেঁচামেচিতে হরিপদবাবু উঠে, “কে, কে বলে চেঁচাতে পালিয়ে বাঁচি।”
সজনীবাবু হাঁটা বজায় রেখেই বললেন, “ছোঁকরাটা কে?”
“সেই কথাই তো বলছি। ছোঁকরা ভূমিপুত্তুর নয়, উটকো লোক। এই যে আপনার সঙ্গে চার-চারজন মশকরা করছিল, কাউকে চিনলেন?”
সজনীবাবু একটু থমকে গিয়ে বললেন, “না। কারা ওরা?”
“ভূমিপুত্তুর নয় কর্তা, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে সব। দিনদিন সংখ্যা বাড়ছে।”
সজনীবাবু এবার সত্যিই থমকালেন এবং একটু চমকালেনও। বললেন, “কবে থেকে দেখছিস এদের?”
“দিন দুই-তিন হল। দিনমানেও দেখবেন বাজারে সড়কে এরা ঘোরাফেরা করছে, জটলা পাকাচ্ছে।”
“কোথা থেকে আসছে এরা! কী চায়?”
“ছোঁকরাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম তার বাড়ি কোথায়। বলল তো নয়নগড় না কী যেন। নয়নগড় কোথায় কে জানে বাবা, জন্মে শুনিনি।”
“নয়নগড়? ঠিক শুনেছিস?”