সজনীবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, “অ্যাঁ।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। তার চেলাচামুণ্ডারা সব বাড়ি বাড়ি ঢুকে ছুঁচ খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
“সর্বনাশ! এ তো একেবারে ঢোলশোহরত হয়ে গেছে দেখছি। ছুঁচটা বেহাত হওয়ার আগেই যে ওটা আমার হেফাজতে আসা দরকার।”
“কর্তা, অপরাধ যদি না নেন তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”
“কী কথা?”
“এই বিটকেল ভুতুড়ে ছুঁচটা আসলে কার? কোথা থেকে এল?”
সজনীবাবু গর্জন করে বলে উঠলেন, “আমার ছুঁচ, আর কার? একজন সাধু আমাকে দিয়েছিল। বলেছিল, যত্ন করে রাখতে। কিছুদিন আগে ওটা চুরি যায়।”
লক্ষ্মীকান্ত একটু করুণ হাসল। “গত দশ বছরের মধ্যে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও চোর এ বাড়িতে ঢুকেছে বলে শুনিনি। যদি ঢুকতে পারে তা হলে তাকে নিখিল নবাবগঞ্জ দলিত তস্কর সমাজ থেকে সোনার মেডেল দেওয়া হবে।”
“অ্যাঁ! এতদুর আস্পর্ধা তাদের!”
“কোনও চোর আপনার বাড়িতে ঢুকলে সে-খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ত।”
নিজেকে সামলে নিয়ে সজনীবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “বাইরের চোর নাও হতে পারে। বাড়ির ভেতরকার কারও কাজ হওয়া অসম্ভব নয়। বাড়ি ভর্তি কাজের লোক, পাইক-বরকন্দাজ। সর্ষের মধ্যেই তো ভূত থাকে। কিন্তু জিনিসটা আজ রাতেই উদ্ধার করতে হবে। পারবি? হাজার টাকা বকশিশ। “
করুণ একটু হেসে লক্ষ্মীকান্ত বলল, “পারব কিনা জানি না। তবে শেষ চেষ্টা একটা করে দেখতে পারি।
“দ্যাখ বাবা, দ্যাখ।”
লক্ষ্মীকান্ত বিদায় হলে সজনীবাবু ওপরে উঠে নিজের ঘরে এলেন। লক্ষ্মীকান্ত ভয় খেয়েছে। ভয়-খাওয়া লোককে দিয়ে কার্যোদ্ধারের আশা কম। সজনীবাবু তাড়াতাড়ি বেরোনোর পোশাক পরে নিলেন। বাইরে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। তবে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে বেশ। একটা বাঁদুরে টুপি পরে হাতে মোটা বেতের লাঠিগাছটা নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সদর দরজা দিয়ে বেরোলে দরোয়ান দেখতে পারে। রাত মোটে দুটো বেজে কুড়ি মিনিট, এসময়ে তো আর কেউ প্রাতভ্রমণে বেরোয় না। সুতরাং দরোয়ানরা যাতে কিছু সন্দেহ না করে সেইজন্য পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে এলেন। টর্চ জ্বেলে রাস্তাটা দেখে নিলেন একটু। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা, দু’ধারে বড় বড় গাছ আর ঝোঁপঝাড়। সজনীবাবু খুশিই হলেন। যে কাজে যাচ্ছেন তার বেশি সাক্ষীসাবুদ না থাকাই ভাল।
বেশ জোরকদমেই এগোচ্ছিলেন, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ভারী বিনয়ী গলায় বলে উঠল, “সজনীবাবু যে! কী সৌভাগ্য! তা প্রাতভ্রমণে বেরোলেন নাকি?”
সজনীবাবু ধাঁ করে ঘুরে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, ধুতি আর জামা পরা, মাথায় গামছা বাঁধা বেঁটেখাটো একটা লোক। মুখে বিগলিত হাসি। হাত দুটো জোড় করে আছে। সজনীবাবু গম্ভীর মুখে শুধু বললেন, “হুম।”
“তা ইয়ে সজনীবাবু, বলছিলাম কী, সুয্যিঠাকুর কি আজ একটু তাড়াতাড়িই উঠে পড়বেন বলে আপনার মনে হয়?”
“কেন বলো তো?”
“এই ভাবছিলাম যে, সজনীবাবু যখন প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন তখন সুয্যিঠাকুরও আজ বুঝি একটু পা চালিয়েই এসে পড়বেন।”
“তাতে কি তোমার সুবিধে হয়?”
“তা একটু হয় বটে। গোরুটা সন্ধেবেলা ঘরে ফেরেনি, সেই কখন থেকে বেটিকে গোরুখোঁজা করে খুঁজছি। অন্ধকারে কোথায় সেঁধিয়ে বসে আছে কে জানে! আলোটা ফুটলে একটু সুবিধেই হবে।”
“তা বটে।” বলে সজনীবাবু হাঁটতে লাগলেন।
লোকটা সঙ্গ ছাড়ল না। পিছু পিছু আসতে আসতে বলল, “তবে কিনা সুয্যিঠাকুরের তো শুধু এই নবাবগঞ্জ নিয়েই কারবার নয়। আরও পাঁচটা গাঁ গঞ্জও তো আছে। সব জায়গায় আলো ফেলতে গেলে পাল্লাটা তো নেহাত কম দাঁড়াবে না। কী বলেন?”
“তা বটে। তা হলে তুমি এবার তোমার গোরু খুঁজতে শুরু করো। দিনকাল ভাল নয়, গোরুচোরেরও খুব উপদ্রব হয়েছে। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে ফেলল। আমি বরং এগোই।”
“যে আজ্ঞে, যে আজ্ঞে।”
কিন্তু দশ পা যেতে-না-যেতেই প্যান্ট শার্ট পরা একটা ফচকে চেহারার ছেলের সামনা-সামনি পড়ে গেল। জ একটু কুঁচকে বলল, “মিস্টার চৌধুরী যে! এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন নাকি? ভেরি গুড, ভেরি গুড। কিন্তু এই কোল্ড ওয়েদারে আবার সর্দি ক্যাচ করে ফেলবেন না তো? ওয়াকিং স্টিকের বদলে একটা আমব্রেলা নিয়ে বেরোলেই তো পারতেন।”
সজনীবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “হুম। তা তুমি এত রাতে পথে বেরিয়েছ কেন হে ছোঁকরা?”
“আর বলবেন না। লাইফটাই ডিসগাস্টিং। ঘরে ক্যান্টাং কারাস ওয়াইফ থাকলে যা হয়। ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন থেকে একটা শো-ডাউন হয়ে গেল। তাই মাথাটা ঠাণ্ডা করতে একটু ওপেনিং-এ বেরিয়েছি।”
“বেশ, বেশ, মাথাটা ভাল করে ঠাণ্ডা করো। আমি এগোই।”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। বাই মিস্টার চৌধুরী।”
সজনীবাবু তৃতীয় বাধাটা পেলেন আরও বিশ গজ হাঁটার পর। একজন আধবুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল। তাঁকে দেখেই বিড়িটা ফেলে দিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “কে যায় রে! আরে এ যে গরিবের মা-বাপ সজনীরাজা। তাই বলি, আমরা কি যার-তার রাজ্যে বাস করি রে রেমোর মা? এ হল সজনীরাজার রাজত্ব। চারদিকে খেয়াল রাখেন। চারদিকে কান, চারদিকে চোখ, চার হাতে আগলান আমাদের, চার পায়েনা না এটা ভুল হয়ে যাচ্ছে।”
সজনীবাবু কটমট করে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “থাক থাক, আর তেল দিতে হবে না।”