ল্যাম্প রেখে দিয়ে একটা বড় টর্চ হাতে বেরিয়ে হলঘরে পা দিলেন। হলঘরের দেওয়ালে বড় বড় অয়েল পেন্টিং। অনেক পুরনো সব ছবি, সাহেবদের আঁকা। এসব ছবিরও লাখো লাখো টাকা দাম। ছবিগুলোর পেছনে গুপ্ত সব কুলুঙ্গিতে কোনওটাতে গয়না, কোনওটাতে পুরনো পুঁথিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, কোনওটাতে পুরনো আমলের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা। ছবিগুলো একটু করে সরিয়ে দেখে নিলেন সজনীবাবু। না, সব কুলুঙ্গিই চাবি দেওয়া রয়েছে।
হল পেরিয়ে পেছন দিকের নির্জন ঠাকুরদালানে এসে পড়লেন সজনীবাবু। নিঃশব্দে তালা খুলে দোতলার মস্ত ঠাকুরঘরে ঢুকলেন। নিরেট রুপোর মস্ত সিংহাসনে সোনায় বাঁধানো হামা দেওয়া গোপালের মূর্তি। সূক্ষ্ম নেটের মশারিতে ঢাকা।
তিনি দেওয়ালের পেরেকে টাঙানো চামরটা নামিয়ে আনলেন। চামরটার হাতল রুপোয় বাঁধানো। সজনীবাবু হাতলটা ঘোরাতে লাগলেন। হাতলটার প্যাঁচ খুলে যেতে লাগল।
হাতলটা খুলে ফাঁপা অভ্যন্তরে টর্চের আলো ফেললেন সজনীবাবু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফাঁপা হাতলের ভেতরটা আজও ফাঁকা। হাতলটা আবার জুড়ে দিয়ে চামরটা যথাস্থানে রেখে সজনীবাবু বেরিয়ে এলেন। পেছনের দরদালান পার হয়ে একটা অব্যবহৃত সরু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে সিঁড়ির তলায় পেছনের একটা ছোট্ট দরজার হুড়কো খুললেন, বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
সজনীবাবু চাপা গলায় বললেন, “কী খবর রে লক্ষ্মীকান্ত?”
“আজ্ঞে, মনে হচ্ছে সন্ধান পেয়েছি।” সজনীবাবু সিধে হয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, “পেয়েছিস? কোথায় সেটা? কার কাছে?”
“আজ্ঞে, গবাক্ষবাবুর কাছে।”
“কী করে বুঝলি?
“আপনার কথামতো বাড়ি বাড়ি আঁতিপাঁতি করে রোজ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আজ মাঝরাতে অলিন্দবাবুর বাড়িতে ঢোকার জন্য জানলার শিক খুলছিলাম, তখন হঠাৎ দেখি গবাক্ষবাবুর বাড়ি থেকে একটা তেজালো আলো বেরোচ্ছে।”
“হ্যাজাক বা টর্চের আলো নয় তো!”
“আজ্ঞে না। ওসব আলো আমরা ভালই চিনি। এ অন্যরকম আলো। খুব তেজি আলো, আর খুব মিঠে।”
সজনীবাবু সোল্লাসে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরকমই আলো হওয়ার কথা। তারপর কী করলি?”
“তাড়াতাড়ি গবাক্ষবাবুর গবাক্ষে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু আলো ততক্ষণে নিভে গেছে।”
“জিনিসটা হাতিয়ে আনতে পারলি না? একখানা রদ্দা মারলেই তো গবাক্ষর হয়ে যেত।”
“আজ্ঞে, সুবিধে হল না। কারণ সেই সময়ে একটা সা জোয়ান লোক কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে জানলার ওপর হামলে পড়ল।”
“কে লোকটা?”
“কস্মিনকালেও দেখিনি, তবে বিরাট চেহারা। আমি গা-ঢাকা দিয়েছিলাম।”
“চিনতে পারলি না! সে কী রে! কী করল লোকটা?”
“আজ্ঞে, জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরপানে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর হুড়মুড়িয়ে চলে গেল।”
“এই রে! তা হলে তো অন্যেরও নজর পড়েছে! আর দেরি করা মোটই উচিত হবে না। তা লোকটা চলে যাওয়ার পর তো তুই ঘরে ঢুকে জিনিসটা কেড়ে আনতে পারতিস।”
“তারও অসুবিধে ছিল। উলটোদিকের নরহরিবাবুর বারান্দায় জ্ঞানপাগলা বসে ছিল যে! লোকে বলে সে নাকি ছদ্মবেশী রাজপুত্তুর আর খুব জ্ঞানী লোক।”
সজনীবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “জ্ঞানপাগলা লোকটা কে বল তো! গত সন্ধে থেকে তার কথা শুনছি। লোকটা কোথা থেকে এসে উদয় হল?”
“তা জানি না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সজনীবাবু বললেন, “তা তাকেও তো একটা রদ্দা কষাতে পারতিস!”
“আজ্ঞে, সেটাই মতলব ছিল। ভাবলাম, গবাক্ষবাবুর ঘরে ঢোকার আগে পাগলাটার ব্যবস্থা করে নিই। গবাক্ষবাবুর সঙ্গে কিছুক্ষণ আগডুম বাগড়ম কথা কয়ে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলাম। মনে হল, গবাক্ষবাবু রাতে সজাগ থাকবেন। আর সজাগ গেরস্তর ঘরে ঢুকতে গেলে একটু সাড়াশব্দ হবেই। পাগলটা ঘুমোচ্ছিল। সোজা গিয়ে তার মাথায় একটা ঘেঁটে লাঠি জোরে বসিয়ে দিলাম।”
“বাঃ বাঃ, পাগলটা চোখ ওলটাল বুঝি?”
“আজ্ঞে না। ব্যাপারটা অত সোজা নয়। লাঠি বসাতেই পাগল বাঁ হাতে কোন কায়দায় কে জানে– লাঠিটা কপ করে ধরে ফেলল, তারপর ডান হাতে একখানা যা ঘুসি ঝাড়ল, বাপের জন্মে ওরকম ঘুসি খাইনি।”
“বলিস কী!”
“টর্চবাতিটা আমার মুখে ফেলুন। দেখছেন তো বাঁ গালের হনুটা কেমন লাল হয়ে ফুলে আছে। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল।”
“তারপর?”
“ঘুসি খেয়ে ছিটকে বারান্দা থেকে জলকাদায় পড়ে গেলাম। অন্য কেউ হলে মুছা যেত। আমি লক্ষ্মীকান্ত–এককালে বিস্তর পুলিশের গুতো খেয়েছি বলে হাড় পেকে গেছে। কোনওরকমে উঠে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।”
“সর্বনাশ! তা হলে পাগলটাও কি টের পেল?”
“আপনাকে একটা কথা বলি কর্তা। আপনি আমাকে ছিচকে চুরি ছাড়িয়ে আপনার কাজে বহাল করার পর থেকে এ-তল্লাটের চোরেরা আমায় এড়িয়ে চলে। দোকানদার বলেই তারা আমাকে জানে। তাতেই তারা নাক সিঁটকোয়। যদি জানত যে দোকানটা আসলে একটা মুখোশ, তলায় তলায় আমি আপনার হয়ে চোরের ওপর বাটপাড়ি করি তা হলে তারা আমার ছায়াও মাড়াত না।”
“আহা, ওসব কথা উঠছে কেন? তোকে কি আমি খারাপ রেখেছি?”
“আজ্ঞে না, ভালই রেখেছেন। মাস গেলে বাঁধা মাইনে পাই। দোকান থেকেও আয় হয়। কিন্তু বাজারে আমার মানমর্যাদা নেই। সে যাকগে, ওসব দুঃখের কথা বলে কী হবে! আসল কথা হল চোরেরা আমাকে আজকাল আর কোনও গুপ্ত খবরটবর দেয় না। তবু কানাঘুষো শুনছি, ওই বিটকেল ছুঁচটা নাকি তারা তান্ত্রিকও খুঁজছে।”