“কী কাণ্ড?”
“হুড়মুড়িয়ে তিনি এসে হাজির।”
“তিনিটা কে?”
“আজ্ঞে, তা বলি কী করে? শুধু জানি দশাসই চেহারা। এসে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরপানে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। আমি একটু গা-ঢাকা দিয়ে পেছনেই ছিলুম। দেখলুম ভয়ে আপনার প্রাণ ছাড়ার উপক্রম। আর তখন আপনার নেমকহারাম টর্চবাতিটাও কেমন বেইমানি করল বলুন। জ্বলল না, জ্বললে তেনাকে দেখতে পেতেন।”
“তিনিটা কে জানো?”
“আজ্ঞে না। কস্মিনকালেও দেখিনি।”
“ইনি তারা তান্ত্রিক নন তো?”
“তারা তান্ত্রিক? মানে সেই জটেশ্বরের জঙ্গলের বামাঠাকুরের কথা বলছেন নাকি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তিনি নন তো৷”
“আজ্ঞে, এই পাপচোখে তো তাঁর দর্শন হয়নি এখনও। দিন চারেক গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়ে ছিলাম। তা বাবাঠাকুর নাকি সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করে সারাক্ষণ দুনিয়া চষে বেড়ান। তাই তাঁকে চোখের দেখাটা হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি কি আর ওই শস্তার টর্চবাতির জন্য রাতবিরেতে পঞ্চমুণ্ডির আসন ছেড়ে উঠে আসবেন?”
“তবে লোকটা কে?”
“বলা কঠিন মশাই। নবাবগঞ্জে নতুন নতুন সব জিনিস আসছে। ভয়ের কথাই হল।”
“এখন বলল তো তুমি কে?”
“শুনে কী করবেন? পুলিশে খবর দেবেন নাকি? সে গুড়ে বালি। আমাদেরও যে শ্রীকৃষ্ণের মতো একশো আটটা করে নাম।”
“আহা, পুলিশের কথা উঠছে কেন? নবাবগঞ্জের পুলিশদের আমি ভাল করেই চিনি। চোর ডাকাতের কথা শুনলে তারা সবার আগে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় গিয়ে লুকোয়।”
“যে আজ্ঞে। তারা বুদ্ধিমান। আমার নাম হল গদাই দাস।”
“বাঃ, বেশ নাম।”
ভারী লজ্জার গলায় গদাই বলে, “কী যে বলেন। গদাই আবার একটা নাম হল! তবে কিনা পিতৃদত্ত নাম। তার মর্যাদাই আলাদা। এই পঞ্চার কথাই ধরুন। এমন আহাম্মক দুটি দেখিনি! পিতৃদত্ত নামটা অপছন্দ হওয়ায় কাছারিতে গিয়ে নাম পালটে কী যেন একটা হয়ে এল, তাও আবার পয়সা খরচ করে।”
“হ্যাঁ, জানি। প্রিয়ংবদ।”
“তাই হবে। কোনও মানে হয়? তা আপনি তাকে চেনেন নাকি?”
“তল্লাটের সব চোরকেই চিনি। শুধু গদাই দাসকেই চিনতুম
।”
“আজ্ঞে, নতুন আসা। জামালগঞ্জ গাঁয়ে ছিলুম, তা সেখানে তেমন সুবিধে হচ্ছিল না। ওইটুকু একটা গাঁয়ে আটচল্লিশজন চোর, ভাবতে পারেন? চোরে চোরে একেবারে ধূল পরিমাণ। সরু চোর, মোটা চোর, ট্যারা চোর, কানা চোর, ঢ্যাঙা চোর, বেঁটে চোর, কালো চোর, ধলা চোর, বাঁকা চোর, সিধে চোর–চোরের চিড়িয়াখানা যেন। রাতে পথে বেরোলে চোরে চোরে ধাক্কা লাগত মশাই। শেষে চোরের বাড়িতেও চুরি করতে চোর ঢুকতে শুরু করল। তখন আমার মনে হল, এ তো অধর্ম হয়ে যাচ্ছে। চোরের বাড়িতে চুরি করা তো মহাপাপ।”
“তাই এই গাঁয়ে এসে থানা গাড়লে বুঝি?”
“যে আজ্ঞে। আশীর্বাদ করবেন যেন কাজেকর্মে একটু সুবিধে করে উঠতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণই ভরসা।”
“তা তো বটেই। তবে আমাদের শ্রীচরণের চেয়ে নিজের দু’খানা শ্রীহস্তের ওপরেই ভরসা করাই ভাল।”
“কী যে বলেন গবাক্ষকর্তা। আমরা হলাম আপনাদের পায়ের নীচে পড়ে থাকা সব মানুষ। তা ইয়ে টর্চবাতিটা কি আর একবার জ্বালাবেন নাকি কর্তা?”
গবাক্ষ আবাক হয়ে বললেন, “কেন হে, টর্চ জ্বালব কেন?”
“সত্যি কথা বলতে কী গবাক্ষকর্তা, জীবনে অনেক টর্চবাতি দেখেছি বটে, কিন্তু এমন তেজালো আলো আর কোনও টর্চ বাতিতে দেখিনি। তাই আর একবার দেখে চোখটা সার্থক করতে চাই। কেলোর দোকানে পাওয়া যায় বলছেন? আজ রাতেই দোকানটায় হানা দিতে হবে।”
গবাক্ষ প্রমাদ গুনলেন। গদাই দাস যে আলো দেখেছে তা টর্চবাতির আলো নয়। কিন্তু সেটা তো আর কবুল করা যায় না। তাই বললেন, “না হে গদাই, টর্চটা বোধ হয় গেছে। জ্বলতে চাইছে না। টর্চবাতি সম্পর্কে তুমি যা বলেছ সেটা অতি খাঁটি কথা। কখন যে জ্বলবে, কখন যে জ্বলবে না তার কোনও ঠিক নেই। বরং আর একদিন এসো, দেখাব।”
অমায়িক গদাই দাস বলল, “যে আজ্ঞে। তা হলে ওই কথাই রইল।”
গদাই দাস বিদায় নেওয়ার পর গবাক্ষ জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। রাতে আর ঘুম হবে না। মাথাটা গরম।
.
টুং করে একটা মৃদু ঘণ্টার শব্দ হল। মাঝরাত্তিরে সজনীবাবু বিছানা ছেড়ে উঠলেন। দেওয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজে। ল্যাম্পের আলোটা উসকে দিয়ে তিনি চারদিকটা দেখলেন। না, সব ঠিকঠাক আছে। বেশি ধনসম্পদ থাকার এই এক অসুবিধে। সবসময়ে একটা ভয় থাকে। নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যায় না। সজনীবাবুর আজকাল ঘুম বিশেষ হতে চায় না সেই কারণেই। তার ওপর নতুন একটা দুশ্চিন্তা যোগ হয়েছে সন্ধে থেকে। জ্ঞানপাগলা নামে উটকো লোকটা কোত্থেকে এসে জুটল? ভেবে ভেবে মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। তাঁর বাড়ি দুর্গের মতোই নিরাপদ। ঘরের দরজা জানলা আঁটা, বাইরে পাইক বরকন্দাজ পাহারায় আছে, আছে পোষা কুকুর। তা সত্ত্বেও নিশ্চিন্তে থাকাটা তাঁর আর হয়ে উঠল না।
ধনসম্পদ তো তাঁর শুধু একটা ঘরেই নয়, বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন কৌশলে সব লুকিয়ে রাখা আছে। সব ঠিকঠাক আছে কি না তা পরখ করে দেখার সবচেয়ে ভাল সময় হল মধ্যরাত।
ল্যাম্পটা উসকে নিয়ে তার আলোয় নিজের ঘরের সিন্দুকটা আগে খুললেন সজনীবাবু। হিরের বাক্সে গোটা পঞ্চাশেক ছোট বড় হিরে, মুক্তোর বাক্সে শতখানেক মুক্তো, মোহরের বাক্সে শ’ পাঁচেক মোহর ইত্যাদি সব ঠিকঠাকই আছে। আলমারি খুলে সোনা আর রুসোর অন্তত শ’দুয়েক থালা বাসন দেখে নিলেন।