কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই জিনিসটি তাঁর নয়। তারা তান্ত্রিক জিনিসটা খুঁজে বের করতে তার চোরছ্যাঁচোড় চেলাচামুণ্ডাদের লাগিয়ে দিয়েছে। সুতরাং জিনিসটাকে রক্ষা করতে হলে বুদ্ধি খাটানো দরকার। ছিপিটা বন্ধ করার পর আলোটা ধীরে ধীরে কমে এল, এবং মিনিট তিনেক পর একদম নিভে গেল।
হাঁফ ছেড়ে শিশিটা ফের তোশকের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়ে গবাক্ষবাবু ভাবতে বসলেন। মাথাটা গরম। ভয়ে বুকটা একটু ঢিপঢিপও করছে। প্রথম ভয় তারা তান্ত্রিককে। সে কেমন লোক জানেন না। দ্বিতীয় ভয়, ভৌতিক ছুঁচটাকে। কীরকম ভূত ছুঁচটায় ভর করে তাও তাঁর জানা নেই। আদপে ভূত সম্পর্কে কোনও অভিজ্ঞতাই গবাক্ষবাবুর ছিল না এতকাল। তারা তান্ত্রিক আর ভূতেরা মিলে কতটা উপদ্রব করবে তাও আন্দাজ করতে পারছেন
গবাক্ষবাবু। এখন উপায় হল জিনিসটা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভিন গাঁয়ে রেখে আসা। সেখানে মেলা লোকলশকর আছে। চট করে বেহাত হওয়ার ভয় নেই।
হঠাৎ শিরশিরে ঠাণ্ডা একটা বাতাস ঘাড়ে মাথায় কানে এসে লাগতেই গবাক্ষবাবু শিউরে উঠলেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, জানলাটা দুহাট করে খোলা। কী করে খুলল তা বুঝতে না পেরে গবাক্ষ হাঁ করে চেয়ে রইলেন। একটু শব্দও হয়নি তো! ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। কাঁপতে কাঁপতে টর্চটা তুলে
জানলায় ফেললেন। কেউ নেই।
টর্চটা নিভিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় গবাক্ষবাবু শক্ত হয়ে বসে রইলেন। জানলায় উঁকি দিয়ে কেউ কাণ্ডটা দেখে ফেলল নাকি? সে কি তারা তান্ত্রিকের চর! না কি ছুঁচের ভূত!
অন্ধকার জানলাটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইলেন গবাক্ষবাবু। জানলা থেকে চোখ সরাতে চেষ্টা করেও পারলেন না।
আচমকাই অন্ধকার জানলায় একটা আবছা মূর্তি দেখা দিল।
গবাক্ষবাবুর হাত-পা অবশ। তবু প্রাণপণে টর্চটা তুলে আলো ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শস্তার টৰ্চবাতির সুইচটা ঠিক এই সময়েই গণ্ডগোল করল। টর্চ জ্বলল না।
গবাক্ষবাবু গর্জন করার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু গলা চিরে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বেরোল। প্রায় ফিসফিস করেই তিনি বললেন, “কে? কে ওখানে?”
জানলার অন্ধকারে হঠাৎ এক জোড়া চোখ বাঘের মতো দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
গবাক্ষবাবু প্রাণপণে “রাম রাম রাম রাম” জপ করতে লাগলেন। বুক ঢিপঢিপ করতে করতে দামামার শব্দ হতে লাগল বুকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। গবাক্ষবাবুর মনে হল এবার মূর্ছা গেলে ভয়ের হাত থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু মূৰ্ছা যাওয়ার চেষ্টা করে দেখলেন, মুছাটাও কেমন যেন আসতে চাইছে না।
জানলার গা ঘেঁষে বাইরে একটা করবী ফুলের গাছ আর কামিনী ফুলের ঝোঁপ। ডালপালা আর ঝোঁপঝাড়ে হঠাৎ একটা আলোড়ন উঠল। ক্ষীণ হলেও একজোড়া ভারী পায়ের শব্দ দূরে চলে যেতে শুনলেন গবাক্ষবাবু।
হাঁফ ছেড়ে গবাক্ষবাবু বলে উঠলেন, “গেছে!”
একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনিও বলে উঠল, “গেছে!” গবাক্ষবাবু ফের শোয়ার তোড়জোড় করতে করতে হঠাৎ থমকালেন। প্রতিধ্বনি তো হওয়ার কথা নয়?
গবাক্ষবাবু পরখ করার জন্য ফের বললেন, “গেছে তা হলে!”
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ একটা গলা বলে উঠল, “আজ্ঞে, গেছে। জোর বেঁচে গেছেন কর্তা।”
গবাক্ষবাবু শুতে যাওয়ার ভঙ্গি থেকে পট করে সোজা হয়ে বললেন, “কে? কে রে?”
জানলার বাইরে থেকে ক্ষীণ সরু গলায় কে বলল, “এই আমি।”
“আমিটা কে?”
“একজন লোক।”
গবাক্ষবাবু বুঝলেন অশরীরী নয়, মানুষই বটে, সাহস পেয়ে বললেন, “লোক মানে? কেমন লোক?”
“আজ্ঞে ভালও বলতে পারেন, মন্দও বলতে পারেন। ভাল মন্দ মিশিয়ে আর কী!”
“কোনদিকের পাল্লা ভারী? ভাল দিকে না মন্দের দিকে?”
“তা এই মন্দের দিকেই বোধ হয় একটু ভারী।”
“চোর নাকি তুই?”
“আহা, প্রথম আলাপেই হুট করে চোরছ্যাঁচোড় বলাটা কি উচিত হচ্ছে মশাই? ধীরেসুস্থে ভেবেচিন্তে তারপর হাতের কাজ দেখে না হয় বলবেন।”
“অ। প্রেস্টিজে লাগল বুঝি?”
“আজ্ঞে, পেটের দায়ে দু-একটা অপকর্ম করি বটে, কিন্তু গায়ে তো এখনও মানুষের চামড়াখানা আছে। সত্যি কিনা বলুন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গবাক্ষ বললেন, “তা বটে।”
“তা টর্চটা নতুন কিনলেন বুঝি?”
টর্চটা সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে ধরে গবাক্ষ বললেন, “কেন, টর্চের কথা উঠছে কেন?”
“না, জিজ্ঞেস করছিলাম, কত দিয়ে কিনলেন। আজকাল টর্চবাতির যা দাম হয়েছে মশাই, তা আর কহতব্য নয়।”
গবাক্ষ সতর্ক হয়ে বললেন, “দামি জিনিস নয় রে বাপু, কেলোর দোকান থেকে শস্তায় কেনা।”
“তাই বলুন, তবে কিনা টর্চবাতির মতিগতির কোনও ঠিক নেই। আমারও একখানা ছিল বটে, কিন্তু কম্মের নয়। যখন ইচ্ছে হল জ্বলল, যখন ইচ্ছে না হল মুখোনা কালো করে রইল। বড্ড নেমকহারাম জিনিস মশাই। অত ভেজাল দেখে আমার বড় সম্বন্ধীকে টর্চখানা দিয়ে দিলুম। এখন ঝাড়া হাত-পা। অন্ধকারেই চোখ বেশ সাবুদ হয়ে গেছে।”
“তা টর্চ নিয়ে এত কথা উঠছে কেন জানতে পারি?”
“আজ্ঞে, সেই কথাটাই বলছি। এই পথ ধরেই একটা বাণিজ্য করতে বেরিয়েছিলুম। দিনটাও ভাল। বৃষ্টি পড়ছে, অন্ধকার রাত, ঘরে ঘরে মানুষজন দিব্যি মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। বড্ড ভাল দিন ছিল আজ। তা হঠাৎ দেখলুম আপনার ঘরে এত রাতেও দিব্যি ফটফট করছে আলো। দেখে ভাবলুম, গবাক্ষকর্তা কি বিজলি বাতি জ্বালালেন নাকি ঘরে, না কি হ্যাজাক লণ্ঠন। উঁকি মেরে দেখতে এসে দেখি, আপনি একখানা টর্চবাতি নিয়ে বসে আছেন। ভাবলুম, বাঃ, টর্চবাতির এলেম তো কম নয়? আর তারপরেই কাণ্ডখানা হল।”