“ও বাবা! তাও তো বটে! তুই তো আবার নয়নগড়ের যুবরাজ! তা হলে বারান্দাতেই না হয় কিছু পেতেটেতে দিই।”
“কী দেবে? চট তো! ওসবে আমার সম্মান থাকে না। তার চেয়ে এই মেঝেতে বেশ বসে আছি। ভূমির অধিপতি ভূমিতে বসলে মান যায় না।”
নরহরি একটু অপ্রতিভ হলেন।
তাঁর গিন্নি ভাতের থালা নিয়ে এলে জ্ঞানপাগলা বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, আজ তো তোমাদের পালা নয়! আজ গজাননের পালা ছিল। তোমাদের যদি একান্তই ইচ্ছে হয় তা হলে পরশুদিন খাওয়াতে পারো। আর শোনো, ওইসব ঘ্যাঁট ম্যাট হেঁচকি টেচকি আমি খাই না। খাওয়ালে ঘি দিয়ে ভাজা পরোটা আর আলুর দম খাওয়াবে।”
নরহরি আর চাপাচাপি করলেন না। ঘরে দোর দিয়ে শুয়ে পড়লেন। জ্ঞানপাগলা বারান্দায় বসে রইল।
দৃশ্যটা উলটো দিকের বাড়ি থেকে গবাক্ষবাবু দেখছিলেন। ওই যে জ্ঞানপাগলা বসে আছে, এটা তাঁর একটা অস্বস্তির কারণ হচ্ছে আজ। এক কথা হল, জ্ঞানপাগলা যে হাতা ন্যাতা পাগল নয় তা আজ গবাক্ষবাবু বুঝে গেছেন। দ্বিতীয় কথা হল, জ্ঞানপাগলা নয়নগড়ের রাজপুত্তুর শুনে সজনীবাবু যেন হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন আজ। ভয় পেলেন কিনা বোঝা গেল না, তবে যেন একটু চিন্তায় পড়লেন। গবাক্ষবাবু একটু রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। অস্বস্তিটা সেই কারণেও।
জানলার ফাঁক দিয়ে তিনি আবছা অন্ধকারে খানিকক্ষণ জ্ঞানপাগলাকে লক্ষ করলেন। নরহরির ঘরের আলো নিভে যেতেই জমাট অন্ধকারে আর কিছুই দেখা গেল না।
গবাক্ষবাবু বুক ঠুকে আজ শস্তায় একখানা টর্চ কিনেছেন। তাঁর ঘোরতর সন্দেহ, যে-ছুঁচটা তিনি কুড়িয়ে পেয়েছেন সেটা এলেবেলে জিনিস নয়। তন্ত্রমন্ত্রের কোনও বিশেষ প্রক্রিয়ায় বোধ হয় জিনিসটার দরকার হয়। না হলে তারা তান্ত্রিক তার চোর-চেলাদের ঘরে ঘরে পাঠিয়ে জিনিসটা তল্লাশ করত না। গবাক্ষবাবুর অনুমান, তাঁর ঘরে চোরেরা আবার হানা দিতে পারে। সুতরাং টর্চখানা হাতের কাছে থাকলে সুবিধে হয়।
আজ ভাল করে জানলা দরজা এঁটে তবে শুতে গেলেন গবাক্ষবাবু। তবে জানলা দরজার ওপর বিশেষ ভরসা নেই, কারণ সেগুলো খুবই পলকা। তাই শুয়ে সজাগই থাকলেন তিনি।
রাত একটু গম্ভীর হওয়ার পর তিনি উঠে টর্চ জ্বেলে তোশকের ফুটো দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কাঁচের শিশিটা বের করলেন। ছুঁচের রহস্যটা কী তা জানার কৌতূহল হচ্ছে খুব। তেমন গুরুতর জিনিস হলে এটা বেচে কিছু টাকাপয়সাও পাওয়া যেতে পারে।
ছুঁচটা শিশি থেকে বের করার আগে তিনি ঘরের চারপাশটা ভাল করে টর্চ জ্বেলে দেখে নিলেন। সামনের জানলার একটা পাট খুলে টর্চের ফোকাস ফেলে দেখলেন, নরহরির বারান্দায় জ্ঞানপাগল দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘাড় কাত করে ঘুমোচ্ছে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে। হাওয়াও দিচ্ছে খুব।
জানলাটা বন্ধ করে টর্চের আলোয় শিশিটা ভাল করে দেখলেন গবাক্ষবাবু। শিশিটা ছয় ইঞ্চির মতো লম্বা হবে। তার ভেতরে বেশ মোটাসোটা একটা ছুঁচ। তবে ছুঁচ হলেও মুখ তেমন ছুঁচলো নয়, আর অন্য প্রান্তে সুতো পরানোর ফুটোও নেই। বেশ চকচক করছে জিনিসটা। মরচে টরচে ধরেনি। শিশিটার একটা দিকে কাঁচেরই একটা ছিপি লাগানো। গবাক্ষবাবু সেটা টানা হ্যাঁচড়া করে দেখলেন, বড্ড শক্ত করে আঁটা রয়েছে। একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেন, ছুঁচটা নড়ছে না। জিনিসটা শিশির মধ্যে কিছুতে আটকানো আছে।
ধৈর্যশীল গবাক্ষবাবু ছিপিটা একটা ন্যাকড়া দিয়ে চেপে ধরে প্রাণপণে মোচড় দিতে লাগলেন। আর তাই করতে গিয়ে আচমকা শিশিটা হাত থেকে শানের ওপর ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য! শিশিটা ভাঙল না।
এ কীরকম কাঁচ, কে জানে বাবা! শিশিটা তুলে ফের ছিপিটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। ভয় হল, শিশির মধ্যে তান্ত্রিকের কোনও ভূতপ্রেত আছে কিনা। আর দু নম্বর, ছুঁচটা মন্ত্রপূত কিনা, যদি ছুঁচটা বেরিয়ে এসে পট করে তান্ত্রিকের বাণ হয়ে যায়, তা হলেই বিপদ।
অনেকক্ষণ গলদঘর্ম হওয়ার পর তিনি রান্নাঘর থেকে লোহার সাঁড়াশিটা এনে ন্যাকড়া জড়িয়ে ছিপিটা চেপে ধরে প্যাঁচ কষতে লাগলেন।
হঠাৎ ফট করে একটা শব্দ হয়ে ছিপিটা খুলে গেল। শব্দটা শুনে গবাক্ষ বুঝলেন, শিশিটা বায়ুশূন্য ছিল। ছিপিটা আলগা হওয়ায় হঠাৎ বাতাস ঢুকে শব্দটা হয়েছে। শিশিটা উপুড় করে ছুঁচটা বের করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু সেটা ভেতরে আটকেই রইল।
তারপর যে কাণ্ডটা হল তাতে গবাক্ষবাবুহাঁ হয়ে গেলেন। শিশির ছিপিটা খোলার কয়েক সেকেন্ড পর হঠাৎ ভেতরকার ছুঁচটা দপ করে জ্বলে উঠল। প্রথমে একটু লালচে, তারপর নীলবর্ণ হয়ে সমস্ত ঘরটা আলোয় ভরে গেল। এ যে ভৌতিক কাণ্ড তাতে গবাক্ষবাবুর সন্দেহ রইল না। কিন্তু তাঁর গলায় স্বর ফুটল না বলে চেঁচাতে পারলেন না, আর ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে পড়ায় ছুটে পালাতেও পারলেন না। বড় বড় চোখ করে শুধু হাতের শিশিটার দিকে চেয়ে রইলেন।
আশ্চর্যের বিষয়, অত উজ্জ্বল আলো সত্ত্বেও শিশিটা তেমন গরম হল না। আলোটা এতই উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, ঘরটা দিনের আলোর মতো আলো হয়ে গেল।
হাতে পায়ে সাড় ফিরতে একটু সময় লাগল গবাক্ষবাবুর। তিনি তাড়াতাড়ি শিশির মুখে ছিপিটা এঁটে বসিয়ে দিলেন। ভূতের ভয়ের সঙ্গে তাঁর মাথায় একটা মতলবও খেলা করছিল। সন্ধের পর আর মোমবাতি বা কেরোসিনের পয়সা খরচা করতে হবে না। ভূতের আলো হলেও তো আলোই। সন্ধের পর এই আলোতেই সব কাজকর্ম সেরে ফেলা যাবে।