কানা কালীর মাঠের কাছে পথটা ভারী নির্জন। চারদিকে বন, ঝোঁপঝাড়। সেইখানে গাছতলায় সবুজ রঙের চেককাটা লুঙ্গি আর হাফহাতা গেঞ্জি গায়ে, খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা একটা লোক দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে ছিল। গুলবাগকে দেখে বলল, “সেপাইজি, সেলাম। তা ফাঁড়িতে কি জলের অভাব হয়েছে নাকি? টিউকলটা কি খারাপ?”
গুলবাগ রক্তচক্ষুতে একবার লোকটার দিকে তাকাল। কিছু বলল না।
লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, “আরে আমরা থাকতে আপনি কেন কষ্ট করবেন সেপাইজি? দিন, বয়ে দিয়ে আসি। আমরা পাঁচজন থাকতে এসব ছোট কাজ আপনারা করবেন কেন? ছিঃ ছিঃ, এ যে বড় লজ্জার কথা!”
প্রস্তাবটা গুলবাগের খুব খারাপ লাগল না। মালটা বইতে হবে, তার ওপর বোমা ফাটলে এই ব্যাটার ওপর দিয়েই যাবে। তাই গুলবাগ বালতিটা লোকটার হাতে ছেড়ে দিল।
গুলবাগ আগে, লোকটা পেছনে। গুলবাগ মাঝে-মাঝে পেছনে তাকিয়ে লোকটাকে নজরে রাখছিল।
হঠাৎ লোকটা বলে উঠল, “সেপাইজি, বালতির মধ্যে ভুড়ভুড়ি কাটছে কী বলুন তো! ও বাবা! এ যে ঘুটঘুট করে কেমন একটা শব্দও হচ্ছে।”
“বাপ রে!” বলে গুলবাগ চোঁ-চোঁ দৌড় মারল।
খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা লোকটা একটু হেসে বালতি নিয়ে রাস্তার পাশে ঝোঁপের আড়ালে নেমে গেল। বোমাটা বের করে বালতির জলটা ফেলে দিয়ে বালতিটা একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে গুঁজে দিল। তারপর বোমাটা একটা ঝোলায় পুরে শিস দিতে দিতে জঙ্গলের ভেতরপথ ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দুপুরের মধ্যেই সবুজ চেক লুঙ্গি পরা, হাতাওলা গেঞ্জি গায়ে আর খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা মোট সাতজনকে থানায় ধরে আনা হল।
গুলবাগ সিং প্রত্যেকটার মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে রক্তচক্ষুতে চেয়ে দেখল। এমনকী দিনের আলোতেও টর্চ ফোকাস করে খুঁটিয়ে নিরখ-পরখ করে তারও প্রত্যেককেই সেই লোকটা বলে মনে হতে লাগল। হাল ছেড়ে দিয়ে সে বলল, “বড়বাবু, এদের সবকটাই বদমাশ বলে মনে হচ্ছে। সবকটাকেই বরং হাজতে পুরে রাখি।”
একথা শুনে সাতটা লোকই মহা শোরগোল তুলে ফেলল। তার গতকাল এগারোজন বামাচরণের ঘটনা জানে। তারাও বলতে লাগল, “আমরা মানহানির মামলা আনব। …সরকার বাহাদুরের কাছে বড়বাবুর নামে নালিশ জানাব… আমাদের এরকম নাহক হয়রানির জন্য মোটা টাকা না দিলে ছাড়ব না…ওরে ভাই, এতক্ষণে আমার দেড় মন মাছ পচে নষ্ট হয়ে গেল, কম করেও হাজার টাকা লোকসান…. আর আমার কী হবে, দোকান ফেলে এসেছি, এতক্ষণে সব লুটপাট হয়ে গেছে…”।
মদন হাজরা কানে হাতচাপা দিয়ে বললেন, “ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, যেতে না চাইলে লাঠিচার্জ কর..”
ঠিক এই সময়ে ফের সরু হয়ে খুবই বিনীতভাবে রসময় চক্রবর্তী এসে মদন হাজরার সামনে দাঁড়ালেন।
মদন হাজরা বলে উঠলেন, “আবার আপনি? আপনার আবার কী দরকার?”
রসময় হাতজোড় করে বললেন, “বড়বাবু, বেয়াদপি মাপ করবেন। বলছি কী, এ-সময়টায় মাথাটা ঠাণ্ডা রাখা খুব দরকার।”
“মাথা ঠাণ্ডা রাখব? এসব ঘটলে কি মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায়?”
রসময় বিনীত হাসি হেসে চাপা গলায় বললেন, “যা শত্রু পরে পরে। বুঝলেন কিনা!”
“না, বুঝলাম না।”
“বলছি কী, বোমাটা যদি লোকটা নিয়েই গিয়ে থাকে তাতে একরকম ভালই হয়েছে। থানায় রাখলে কখন ফেটেফুটে থানাই হয়তো উড়ে যেত। তার চেয়ে ও আপদ বিদেয় হওয়াতে একরকম স্বস্তি। ফাটে তো সেই ব্যাটার কাছেই ফাটবে।”
মদন হাজরার মুখটা একটু উজ্জ্বল হল। বললেন, “বসুন ঠাকুরমশাই। বসুন। কথাটা খারাপ বলেননি। বোমাটা থানায় রাখলে বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার হত। সদরে খবর দিলে বম্ব এক্সপার্ট কবে আসবে তার জন্য বসে থাকতে হত। হয়তো ওই সর্বনেশে বোমা নিয়ে আমাকেই সদরে যাওয়ার হুকুম হত। নাঃ, আপনি ঠিকই বলেছেন! আর কিছু বলবেন? আপনি বেশ উপকারী কথা বলতে পারেন দেখছি!”
রসময় বিগলিত হয়ে বললেন, “চেষ্টা করি আর কি।”
“মাথায় কোনও ভাল কথা এলেই আমার কাছে চলে আসবেন।”
“যে আজ্ঞে। আর একটা কথা!”
“কী বলুন তো?”
“প্রতাপরাজার শূলটার কথা ভুলে যাননি তো বড়বাবু?”
“ওঃ, সেই দেড় মন ওজনের লোহার শুল তো, যেটা বামাচরণ জগাপাগলাকে চুরি করতে বলেছিল? না, ভুলিনি, কিন্তু শুলটার রহস্য কী বলুন তো?”
মাথা নেড়ে রসময় বললেন, “আমিও জানি না আজ্ঞে।”
৫. সন্ধেবেলা শিবমন্দিরের চাতালে
সন্ধেবেলা শিবমন্দিরের চাতালে দুজন বসা। রসময় আর জগাপাগলা। সিঁড়ির নীচে কুকুর ভুল। চারদিকটা অন্ধকারে বড্ড ছমছম করছে।
রসময় বললেন, “ও জগা, শুনেছ তো, গগনবাবুর বাড়ির বাগানে একখানা বোমা পাওয়া গেছে।”
“বোমা! বলেন কী ঠাকুরমশাই?”
“হ্যাঁ গো, যে-সে বোমা নয়, মিলিটারি বোমা। সাঙ্ঘাতিক জিনিস। দেখতে অনেকটা আনারসের মতো।”
জগা একটু হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “আনারসের মতো দেখতে! সেটা বোমা হতে যাবে কোন দুঃখে? সেটা তো স্বপ্ন তৈরির কল!”
রসময় অবাক হয়ে বললেন, “স্বপ্ন তৈরির কল? সে আবার কী জিনিস?”
জগা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে পরেশবাবু তৈরি করেছেন। খুব মজার জিনিস।”
রসময় অবাক হয়ে বলেন, “পরেশবাবুটা কে?”
“ভারী ভাল লোক। জিলিপি খাওয়ার জন্য পয়সা দিয়ে গেছেন।”
“তাব সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়?”
জগা মাথা চুলকে বলল, “বড্ড মুশকিলে ফেললেন। বলা বারণ কি না। তবে আপনি বলেই বলছি। পাঁচ কান করবেন না।”