গগনবাবু সকালে বারান্দায় তাঁর ইজিচেয়ারে বসে আছেন। পুজোর ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য তাঁর ছেলে গোবিন্দ আর নাতি পুটু আসায় তাঁর সময়টা ভালই কাটছে। পুটু সিঁড়িতে বসে বারান্দার ওপর একটা রিমোট কন্ট্রোল খেলনা-মোটরগাড়ি চালাচ্ছিল।
হঠাৎ পুটু বলল, “আচ্ছা দাদু, তুমি কখনও বাতাসা-দ্বীপে
গেছ?”
“যাইনি। অনেকবার গেছি।”
“সেখানে কী আছে?”
“কী আর থাকবে! একটা ভাঙা বাড়ি আর গাছপালা।”
“আচ্ছা, বাতাসা-দ্বীপে কি ভূত আছে?”
“ভূত! ভূত আবার কী?”
“খাসনবিশদাদা বলছিল সেখানে নাকি একটা খুব লম্বা ভূত আছে। দশবারো ফুট লম্বা।”
“খাসনবিশ নিজেই একটা ভূত। একসময়ে খাসনবিশও মিলিটারিতে চাকরি করত। তাতেও ওর ভয়ডর কিছু কাটেনি। আমাদের ক্ষ্যান্তদিদি আর খাসনবিশ প্রায়ই নাকি ভূত দেখে। ওদের কথা বাদ দাও।”
“কুনকে আর ভোলা বেজি ধরতে গিয়ে নাকি দেখেছে।”
“গাঁয়ের ছেলেরা কত কী দেখে! ওসব বিশ্বাস না করাই ভাল। এদের শুধু ভয় আর ভয়। সত্যিকারের সাহসী ছেলে একটাও দেখতে পাই না।”
“আচ্ছা দাদু, জগাপাগলা নাকি সত্যিকারের পিস্তল দিয়ে একটা কাক মেরেছে।”
“ওটাও আষাঢ়ে গল্প। পিস্তল ও পাবে কোথায়? পিস্তল কি ছেলের হাতের মোয়া?”
“কিন্তু সবাই যে বলছে!”
“গাঁয়ে গুজবের অভাব কী? এখানে কেউ ভূত দেখে, কেউ পরি নামায়, কেউ মন্ত্রতন্ত্রের জোরে আকাশে ওড়ে কত কী শুনবে।”
ঠিক এই সময়ে ভেতরবাড়ি থেকে বাগানের ভেতর দিয়ে পড়ি-কি-মরি করে খাসনবিশ ছুটে এসে চিৎকার করতে লাগল,
“বোমা! বোমা! কতা, শিগগির পালান…”
গগনবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, “কিসের বোমা? কোথায় বোমা?”
“বাড়ির ভেতরে। ক্ষ্যান্তদিদি সেটা বঁটি দিয়ে কাটবার চেষ্টা করছে।”
কথাটা গগনবাবুর তেমন বিশ্বাস হল না। বললেন, “কীরকম বোমা?”
“আজ্ঞে গ্রেনেড। একেবারে মিলিটারি গ্রেনেড।”
গগনবাবু টপ করে উঠে দাঁড়ালেন। পুটুকে বললেন, “তুমি এখানেই থাকো। আমি আসছি।”
ভেতরবাড়িতে এসে গগনবাবু যা দেখলেন তাতে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। ক্ষ্যান্তমণি বারান্দার শানের ওপর একখানা হাত-দা দিয়ে বোমাটা কাটার জন্য উদ্যত হয়েছে।
গগনবাবু একটা পেল্লায় ধমক মারলেন, “অ্যাই ক্ষান্ত! উঠে আয় বলছি!”
ক্ষান্তমণি গর্জন শুনে অবাক হয়ে বলল, “কী হল বলো তো তোমাদের! সকালবেলায় এত চেঁচামেচি কিসের?”
গগনবাবু দ্রুতপায়ে গিয়ে ক্ষান্তমণিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বোমাটা তুলে নিলেন। মিলিটারিদের হ্যান্ডগ্রেনেড। ভাগ্য ভাল, ফিউজটা অক্ষত আছে। ফাটলে এতক্ষণে ক্ষান্তমণি সহ বাড়ির খানিকটা অংশ উড়ে যেত।
ক্ষান্তমণি পড়ে গিয়ে চিলচ্যাঁচানি চেঁচাচ্ছিল, “ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে রে! মাজাটা যে ভেঙে সাত টুকরো হয়ে গেল বাপ! কোথায় যাব রে! কর্তাবাবুর যে মাথাখারাপ হয়ে গেছে। গিন্নিমা, শিগগির এসো!”
চেঁচামেচিতে গগনবাবুর স্ত্রী, পুত্রবধু এবং বাড়ির অন্য সবাই ছুটে এল। “কী হয়েছে! কী হয়েছে।” বলে মহা শোরগোল।
গগনবাবু ভ্রূ কুঁচকে গ্রেনেডটা দেখছিলেন। বললেন, “এটা তুই কোথায় পেলি?”
ক্ষান্তমণি কোঁকাতে-কোঁকাতে বলল, “কোথায় আর পাব! বাগানে শাক তুলতে গিয়ে দেখি কালো আনারসটা খেতের মধ্যে পড়ে আছে। তা তাতে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়েছে শুনি, যে, এরকম রামধাক্কা দিয়ে আমার মাজাটা ভাঙলে! বুড়ো বয়সের ভাঙা হাড় কি আর জোড়া লাগবে?”
গগনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “তবু তো মাজার ওপর দিয়ে গেছে। আর একটু হলে তো উড়ে যেতি।”
হাঁফাতে-হাঁফাতে খাসনবিশ ফিরে এসে একবালতি জল তুলে আনল চৌবাচ্চা থেকে। গগনবাবু বোমাটা জলের মধ্যে রেখে বললেন, “মদন হাজরাকে ডেকে আন। যদিও সে খুব করিৎকর্মা লোক নয়, তবু জানানোটা আমাদের কর্তব্য।”
আধঘণ্টা বাদে মদন হাজরা সেপাইশাস্ত্রী নিয়ে কাহিল মুখে এসে হাজির হলেন। বললেন, “বিদ্যাধরপুরে এসব কী হচ্ছে মশাই? কাল এক পিস্তলের জের সামলাতে জেরবার হতে হয়েছে, এর ওপর আপনার বাড়িতে বোমা! লম্বা ছুটির দরখাস্ত করে দিয়েছি মশাই, তিন মাস গিয়ে নয়নপুরে মাসির বাড়িতে থেকে আসব।”
জলে ভেজানো বোমাটা দেখে আতঙ্কিত হয়ে মদন হাজরা বললেন, “এ তো ডেঞ্জারাস জিনিস দেখছি।”
গগনবাবু বললেন, “হ্যাঁ, মিলিটারিতে ব্যবহার হয়। হাইলি সেনসিটিভ।”
“তা এটা নিয়ে করব কী বলুন তো!”
“নিয়মমতো থানায় নিয়ে রাখতে হবে। তদন্ত করতে হবে।”
“ও বাবা! যদি ফেটেফুটে যায়?”
“ফিউজটা নাড়াচাড়া না করলে ফাটবার কথা নয়। বালতিসুন্ধুই নিয়ে যান।”
মদন হাজরা চোখ বুজে ঠাকুর-দেবতাকে খানিকক্ষণ স্মরণ করে বললেন, “ওরে গুলবাগ সিং, নে বাবা, জয় সীতারাম বলে বালতিটা নিয়ে পেছনে-পেছনে আয়, একটু দূরে-দুরেই থাকিস বাপ। সবাই মিলে একসঙ্গে মরে তো লাভ নেই রে!”
গুলবাগ সিং যথেষ্ট সাহসী লোক। ডাকাবুকো বলে থানায় তার বেশ সুনাম আছে। গুলবাগ একটা তাচ্ছিল্যের “হুঁঃ” দিয়ে বালতিটা হাতে নিয়ে বলল, “চলুন।”
মদন হাজরা এবং অন্য সেপাইরা আগে-আগে, পেছনে গুলবাগ। কিন্তু পথে নেমেই গুলবাগ দেখল, মদন হাজরা আর সেপাইরা বড্ড জোরে হাঁটছে, হাঁটার চেয়ে দৌড়ই বলা ভাল। জলভরা বালতি নিয়ে ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া হুড়োহুড়ি করলে নড়াচড়ায় বোমাটা ফেটে যেতে পারে। তাই গুলবাগ ঠোঁট-মুখ কুঁচকে আস্তে-আস্তেই হাঁটতে লাগল। ইতিমধ্যে মদন হাজরা আর সেপাইরা এ ওকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করতে করতে প্রাণপণে দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল।