ছোঁকরা ফ্যাচ করে হেসে বলল, “জগাপাগলা, এক মাঘে শীত যায় না, বুঝলে! আমার জগদ্ধাত্রী ক্লাবের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঢিল মেরে তোমার মাথার চাঁদি উড়িয়ে দেবে আজ”
জগা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি কি তোকে কিছু বলেছি রে বামা? বল তো, বলেছি? ওরে, আমার সেই বামাচরণের যে পেল্লায় দাড়িগোঁফ ছিল, তুই তো দুধের শিশু।”
পঞ্চমজন বেশ লম্বা একহারা চেহারার মানুষ। মুখোনা ভারী বিনয়ী। জগা তার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা চাপা গলায় বলে উঠল, “জিলিপি খাবে বলে জষ্টিমাসে যে আড়াইটে টাকা ধার নিয়েছিলে সেটা এবার ছাড়ো তো বাপু। নইলে দারোগাবাবুকেই কথাটা বলতে হয়।”
জগা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “এ নয়। এ একেবারেই বামাচরণ নয়। কিছুতেই নয়। এ হতেই পারে না!”
ষষ্ঠজন এক আখাম্বা তান্ত্রিক। কাঁচাপাকা দাড়ি, রক্তাম্বর, কপালে প্রকাণ্ড তেল-সিঁদুরের তিলক, চোখ দুখানা লাল, চেহারাখানাও পেল্লায়।
জগা হাসি-হাসি মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “বামাবাবু যে! ক’দিনেই চেহারাখানা শুকিয়ে একেবারে আদ্দেক হয়ে গেছে দেখছি? তা বামাবাবাজি–”
তান্ত্রিক বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “জয় শিবশন্তো! জয় মা তারা! তোর মাথায় বজ্রাঘাত হবে রে জগা, এই দিলুম তোকে অভিশাপ–”
তান্ত্রিক অভিশাপ দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই জগা চট করে বসে পড়ল। তারপর একলাফে সরে চারদিকে চেয়ে অভিশাপটা কোথায় পড়ল তা খুঁজে দেখতে-দেখতে বলল, “তা বাজটা কোথায় পড়ল বাবাজি?”
“পড়েনি। পড়বে। তোর নিস্তার নেই রে জগা–”
জগা খুব অভিমানের গলায় বলল, “দিয়েই ফেললেন নাকি শাপটা?”
“এখনও দিইনি। এই দিচ্ছি–”
“থাক, থাক। আপনি মোটেই সেই বামাচরণ নন। সেই বামা পিস্তল নিয়ে ঘোরে, বাজ নিয়ে নয়।”
সপ্তমজন রোগাপাতলা চালাক-চালাক চেহারার একজন লোক। বাহারি সরু গোঁফ, বাবরি চুল, ঠোঁটে পানের দাগ।
বামাচরণ তার কাছাকাছি যেতেই লোকটা খুব মিহি গলায় বলল, “পরশু হাটুগঞ্জে আমাদের ফুল্লরা অপেরার কৃষ্ণার্জুন পালা হচ্ছে। গিয়ে আমার নাম বোলো গেটম্যানকে, বামাচরণ বিশ্বাস, একেবারে সামনের সারিতে বসিয়ে দেবে।”
জগা একগাল হেসে বলে, “কস্মিনকালে দেখিনি মশাই আপনাকে।”
অষ্টমজন মাঝবয়সী একজন নিরীহ লোক। এতক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিল। জগা তার সামনে যেতেই ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠে বলল, “এত হেনস্থাও কপালে লেখা ছিল ভাই জগা? সারা জীবন গরিব-দুঃখীর জন্য এত করলুম, শেষে আমাকে কিনা পুলিশে ধরল?”
জগা সঙ্গে-সঙ্গে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আহা-আহা, কাঁদো কেন বাপু? গরিব-দুঃখীর জন্য খুব করো বুঝি তুমি?”
লোকটা চোখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নেড়ে বলে, “করতে আর পারলুম কই? যতবার গরিব-দুঃখীর জন্য কিছু করতে যাই ততবার আমার মাসি আমাকে বলে, “ওরে বামাচরণ, তোর মতো গরিব, তোর মতো দুঃখী আর কে আছে? তাই আর কিছু করে উঠতে পারলাম না রে ভাই!”
লোকটা জগার কাঁধে মুখ গোঁজার চেষ্টা করায় জগা একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, “আহা, আর কাঁদে না। তোমাকে না হয় ছেড়েই দিচ্ছি।”
“ছাড়বে কেন ভাই। বরং ফাটকেই দাও। তাও তো এরা দু’বেলা দুটি খেতে দেবে!”
নবমজন ঢুলুঢুলু চোখের একজন কেশ বাবু চেহারার যুবক। মুখে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। গুগুন করে একটা সুর ভাঁজছিল।
জগা তার সামনে দাঁড়াতেই লোকটা জিজ্ঞেস করল, “বলো তো কী রাগ?”
জগা তটস্থ হয়ে বলে, “রাগারাগির কী আছে? আমি কি বাপু, রাগের কথা কিছু বলেছি?”
লোকটা মৃদু হেসে বলল, “পারলে না তো? এ হল বেহাগ। আচ্ছা এবার শোনো”
লোকটা ফের গুগুন করে সুর ভাঁজতে লাগল। ভারী আনমনা।
দশ নম্বর লোকটা খুবই বেঁটে। জগার কোমরসমান হবে।
জগা একটু ঝুঁকে দেখে বলল, “বামাবাবুই মনে হচ্ছে যেন!”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, “তা তো বটেই। অধমের নাম বামাচরণ সরখেল। আমার মামাশ্বশুর কে জানো? ডাকসাইটে
উঁকিল হিদারাম রায়। জজেরা তাকে দু’বেলা সেলাম ঠোকে। আমার পিসতুতো শালা হল গয়েশপুরের দারোগা দাশরথি দাস। আমার খুড়শ্বশুর কে জানো? কালিয়াগঞ্জের–”
জগা একটু রেগে গিয়েই বলল, “থাক, থাক, মশাই, আপনার আর বামাচরণ হয়ে কাজ নেই।”
এগারো নম্বর এক বুড়োঘূখুড়ে মানুষ। তাকে দেখেই বিকট গলায় বলতে লাগল, “ক্যা ক্যা ক্যা রে তুই? অলপ্লেয়ে! পাজি! ছুঁচো! কেন ধরে এনেছিস র্যা আমায়? আমার চান-খাওয়ার সময় হয়নি নাকি র্যা? অ্যা, এখন বাজে ক’টা খেয়াল আছে?”
জগা তাড়াতাড়ি পরের লোকটার সামনে গিয়ে একটা নিশ্চিন্তের খাস ছেড়ে বলল, “এই যে! পেয়ে গেছি দারোগাবাবু। এই হল সেই বামাচরণ। একেই ভাল করে ধরুন।”
লোকটা চোখ পাকিয়ে বলল, “ইয়ার্কির আর জায়গা পেলে না? আমি আবার বামাচরণ হলাম কবে? আমি এই থানার সেপাই গুলবাগ সিং।”
জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে জগা বলল, “সেপাইজি! ছিঃ ছিঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে।”
কাণ্ড দেখে বাইরের জমায়েত লোকজন হোঃ হোঃ করে হাসতে লেগেছে। আর এগারোজন বামাচরণ সমস্বরে চেঁচাচ্ছে, “আমরা দেখে নেব। এইভাবে কোমরে দড়ি বেঁধে হাজারটা লোকের সামনে এই যে আমাদের হেনস্থা হচ্ছে এর প্রতিশোধ আমরা নেবই। মদন দারোগার নামে মামলা করব আমরা। জেল খাঁটিয়ে ছাড়ব”…ইত্যাদি।
মদন হাজরার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, গোঁফ ঝুলে পড়েছে, চেঁচামেচি শুনে দু’হাতে কান চাপা দিয়ে মদন হেঁকে বললেন, “সসম্মানে খালাস! সসম্মানে খালাস! ওরে কে আছিস, বামাচরণদের কোমরের দড়ি খুলে দে…”