মন্দিরের পেছনের অন্ধকার বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে একটি ছায়ামূর্তি সর্পিল গতিতে বেরিয়ে এল। তার গায়ে কালো পোশাক। মুখটাও ঢাকা। একটা জোরালো টর্চের আলো ফেলে সে কিছু একটা খুঁজল। তারপর পিস্তলটা দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে নিল। এবার টর্চের আলো গিয়ে পড়ল মরা কাকটার ওপর। ছায়ামূর্তি একটু ইতস্তত করে মরা কাকটার ঠ্যাং ধরে হাতে ঝুলিয়ে দোলাতে-দোলাতে সামনের দিকের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আধঘণ্টা বাদে লোকলস্কর, টর্চ, লণ্ঠন আর লাঠি সমেত রসময় আর জগা ফের ফিরে এল মন্দিরের চাতালে। সকলেই ভীষণ উত্তেজিত।
রসময় বলে উঠলেন, “ওই যে ওই জায়গায় পিস্তলটা পড়ে ছিল, আর ওইখানে কাকটা।”
কিন্তু টর্চের আলোয় কেউ কোথাও কিছু খুঁজে পেল না।
রসিক পাণ্ডা মস্তান গোছের লোক। চারদিক দেখেটেখে বলল, “রসময়, আজকাল গাঁজাটাজা খাচ্ছ না তো?”
রসময় উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এই তো জগা সাক্ষী আছে। ঝোলা থেকে পিস্তল বের করল, পিস্তল ফুটল, গুড়ল ছুটে গেল, কাক মরল–এ যে একেবারে নিয্যস সত্যি ঘটনা।”
জগা জড়সড় হয়ে বলল, “আজ্ঞে তাই। অস্তরটা যে ওরকম সাঙ্ঘাতিক, তা তো জানতুম না।”
রসিক বলল, “এ যে দেখছি চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা। তবু চলো, আরও ভাল করে খুঁজে দেখা যাক। মন্দিরের ভেতর বার কোথাও বাদ রেখো না হে তোমরা।”
কিন্তু বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও কিছুই পাওয়া গেল না। বিষ্ণু নামে একটা ছেলে গাছতলায় টর্চের আলো ফেলে কী দেখছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, “রসিকদা, ঘটনাটা মিথ্যে নাও ২৪
হতে পারে। এখানে ঘাসের ওপর একটু রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে কিন্তু। আর কয়েকটা কাকের পালক।”
সবাই গিয়ে জায়গাটায় জড়ো হল। কয়েকটা টর্চের আলোয় বাস্তবিকই ইতস্তত ছড়ানো কয়েকটা কাকের পালক আর ঘাসের ওপর রক্তের ছিট-ছিট দাগ দেখা গেল।
রসিক পাণ্ডা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “রসময়, একবার যে থানায় যেতে হচ্ছে!”
“কেন ভাই?” “ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তবে থানায় একটা এত্তেলা দিয়ে রাখা দরকার। আর বামাচরণকেও খুঁজে বের করতে হবে। কেমন লোক সে? যার-তার হাতে পিস্তল তুলে দেয়–এ তো মোটেই ভাল কথা নয়! এরপর তো হাটে বাজারে অ্যাটম বোমা বিলি হবে।”
৩. দারোগা মদন হাজরা
দারোগা মদন হাজরা খুবই করিৎকর্মা লোক। পরদিন সকালে তিনি দলবল নিয়ে অ্যাকশনে নেমে পড়লেন। বেলা বারোটার মধ্যে পাঁচ-ছ’টা গ্রাম থেকে মোট এগারোজন বামাচরণকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসা হল। তাদের মধ্যে পনেরো। থেকে পঁচাশি সব বয়সের লোকই আছে। কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা, কেউ কালো, কেউ ধলো, কারও লম্বা সাদা দাড়ি, কারও পাকানো কালো কুচকুচে মোচ। একটা লম্বা দড়ি দিয়ে এগারোজনকেই কোমরে বেঁধে সারি দিয়ে দাঁড় করানো হল।
দৃশ্যটা দেখে মদন হাজরা খুবই খুশিয়াল হাসি হাসলেন। তিনি রোগাভোগা মানুষ, বারোমাস আমাশায় ভোগেন। লোকে তাঁকে আড়ালে চিমসে দারোগা বলে উল্লেখ করে, তিনি জানেন। তিনি যে একজন ডাকসাইটে মানুষ, এ-বিশ্বাস কারও নেই। তাই সুযোগ পেলেই তিনি নিজের কৃতিত্ব দেখানোর চেষ্টা করেন। আজ এগারোজন বামাচরণকে গ্রেফতার করার পর তিনি খুবই আহ্লাদ বোধ করছিলেন। ঝোলা গোঁফের ফাঁকে ফিচিক-ফিচিক হাসতে-হাসতে তিনি জগাকে ডেকে বললেন, “এই যে জগা, তল্লাট ঝেটিয়ে সবকটা বামাচরণকে ধরে এনেছি। এবার বাছাধন, তোমার বামাচরণটিকে দেখিয়ে দাও তো? বেশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে তবে বলবে, বুঝলে তো!”
জগারও আজ আত্মাদ্রে সীমা নেই। থানার সামনে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। সেপাইরা ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বামাচরণরা সবাই এবং জড়ো হওয়া মানুষেরা তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। নিজেকে ভারী কেষ্টবিষ্টু মনে হচ্ছিল জগার।
সে উঠে প্রথম লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, লোকটা ছ’ ফুট লম্বা, তেমনই চওড়া, বিরাট পাকানো গোঁফ, চোখদুটো বাঘের মতো গুলুগুলু।
জগা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ইনিই সেই বামাচরণ। একেবারে হুবহু তিনিই”।
লোকটা চোখ পাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বলল, “অ্যা।”
জগা দুহাত পেছিয়ে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে না। আপনি না। বামাচরণবাবুর বোধ হয় গোঁফ ছিল না।”
দ্বিতীয়জন বেঁটেখাটো, মাথায় টাক, দাড়িগোঁফ কামানো।
জগা তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলে উঠল, “আরে! এই তো বামাচরণবাবু! এই তো সেই–”
লোকটা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “ইয়ার্কি হচ্ছে! ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি, হনুমান কোথাকার!”
জগা চোখ মিটমিট করতে করতে বলল, “আজ্ঞে ইনি হবেন কী করে? বামাচরণবাবুর যে বাঁ গালে আঁচিল ছিল।”
তৃতীয়জন পাকা দাড়িওলা বুড়ো মানুষ। চশমার ফাঁক দিয়ে জগাকে দেখছিলেন। হাতে লাঠি।
জগা গদগদ হয়ে বলল, “পেন্নাম হই বামাচরণবাবু, কতদিন পরে দেখা! সেই যে হাটে বাঘ মারার অন্তরটা দিলেন, তারপর আর দেখাই নেই! ভাল আছেন তো! বাড়ির খোকাখুকিরা সব ভাল?”
একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বুড়ো বামাচরণ বললেন, “হাতের লাঠিটা দেখছ তো! এমন দেব কয়েক ঘা–”
জগা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, “আরে না, আপনার কথা হচ্ছে না, আপনার কথা হচ্ছে না। সেই বামাচরণের তো দাড়িই ছিল না মোটে।”
চতুর্থজন বয়সে ছোঁকরা, ভাল করে দাড়িগোঁফ ওঠেনি। জগা মিটমিট করে তার দিকে চেয়ে থেকে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “বামা না! উঃ, কী সাঙ্ঘাতিক জিনিসই দিয়েছিলি বাপ! কী শব্দ, কী তেজ অন্তরটার!”