“তা দিল নাকি অস্তর?”
খিকখিক করে হেসে জগা বলল, “দেয়নি আবার!”
রসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বললেন, “দিয়েছে! তা কী অস্তর দিল?”
“সে আর আপনার শুনে কাজ নেই।”
বামাচরণ যে-ই হোক, পাগলের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়াটা যে ভাল হয়নি, এটা নিশ্চয়ই। রসময় উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “দেখো বাপু, জিনিসটা সামলে রেখো, বাঘ মারতে গিয়ে আবার মানুষ মেরে বোসো না।”
“আজ্ঞে না, সে-ভয় নেই। মারার মতো মানুষই বা পাব কোথায়? চারদিকে যাদের দেখছি সব তো আধমরা মানুষ। এদের আর মেরে হবে কী?”
রসময় বললেন, “তা অবশ্য খুব ঠিক কথা, তা অস্তরটা কি একেবারে বিনি মাগনা-ই দিল নাকি? পয়সাকড়ি চাইল না?”
“আজ্ঞে না, তবে কথা আছে।”
“কী কথা?”
“অস্তরের জন্য পয়সা দিতে হবে না বটে, কিন্তু একটা কাজ করে দিতে হবে।”
“খেত-টেত কোপাতে হবে নাকি?”
“ওসব নয়। ছোট কাজ আমি ছেড়ে দিয়েছি, এই তো সেদিন ভূপতি চাটুজ্যে তার গোয়াল পরিষ্কার করাল, সারা দিনমান উদয়াস্ত খেটে গোয়ালঘরখানাকে তাজমহল বানালুম, কিন্তু কী জুটল জানেন? তিনটে টাকা, একথালা পান্তা আর একছড়া তেঁতুল, একটু গুড় চেয়েছিলুম, তাইতে চাটুজ্যেগিন্নি এমন খ্যাঁক করে উঠল! না মশাই, ছোটখাটো কাজ আর নয়, বড্ড ঘেন্না ধরে গেছে। নগেন পালের মেয়ের বিয়েতে কম খেটেছি মশাই? বাজার থেকে গন্ধমাদন মাল টেনে আনা, ম্যারাপ বাঁধার জোগালি খাটা, ঝাঁটপাট দেওয়া, জল তোলা, কী জুটেছিল জানেন? সবার শেষে খেতে দিল একটা ঘাট আর ভাত। বলল, সব জিনিস ফুরিয়ে গেছে। হাতে মোটে পাঁচটি টাকা গুঁজে দিল, ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছোট কাজ কি ভদ্রলোকের পোষায়?”
“অতি ন্যায্য কথাই বলেছ বাপু। ওসব কাজ তোমাকে মানায়ওনা, তা একাজটা বেশ মানানসই পেয়েছ তো?”
জগা ঘাড় কাত করে বলল, “দিব্যি কাজ, একখানা জিনিস শুধু দুধসায়রের দ্বীপে রেখে আসতে হবে।”
বিস্মিত রসময় বলে উঠলেন, “বটে! তা জিনিসটা কী?”
“বলা বারণ, তবে পাঁচ কান যদি না করেন তো বলতে পারি।”
“পাঁচ কান করতে যাব কোন দুঃখে?”
“তা হলে বলি, রাজা প্রতাপের একখান শূল আছে, জানেন তো!”
“কে না জানে! প্রতাপরাজার শূল বিখ্যাত জিনিস। দেড় মন ওজন।”
“সেইটেই।” রসময় চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলো কী হে! রাজা প্রতাপের শুল সরাবে, তোমার ঘাড়ে ক’টা মাথা? হরুয়া পালোয়ান
আর দুই ছেলে যখের মতো রাজা প্রতাপের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, তাদের মতো লেঠেল তল্লাটে নেই, তার ওপর তাদের দলবল আছে, তারা সব রাজা প্রতাপের খাস তালুকের প্রজা। সেই আদিকাল থেকে বংশানুক্রমে রাজা প্রতাপের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, তোমার প্রাণটা যে যাবে হে!”
একটু কাঁচুমাচু হয়ে জগা বলল, “সেইটেই যা মুশকিল, তা অস্তর দেখালে ভয় পাবে না?”
“অস্তর দেখাবে? কী অস্তর তাই তো বুঝলুম না!”
“এই যে!” বলে ঝোলায় হাত পুরে একখানা পিস্তল গোছের জিনিস বের করল জগা। তারপর খিকখিক করে হেসে বলল, “আজ্ঞে এসব খুব সাঙ্ঘাতিক জিনিস।”
সাঙ্ঘাতিক কিনা রসময় তা জানেন না, তবে জিনিসটা দেখে তাঁর খেলনা পিস্তল বলেই মনে হল, একটু হেসে বললেন, “ওরে বাপু, ওরা ওসব খেলনা দেখে ভয় পাওয়ার লোক নয়। রাজা প্রতাপের বাড়িতে চুরি-ডাকাতির চেষ্টা বড় কম হয়নি, কিন্তু আজ অবধি কেউ কুটোগাছটি সরাতে পারেনি।”
জগা গুম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “অস্তরটাকে কি খেলনা বলছেন ঠাকুরমশাই?”
রসময় একটু সতর্ক গলায় বললেন, “তা কে জানে! ওসব কখনও নাড়াঘাঁটা করিনি বাপু, ম্লেচ্ছ জিনিস। তবে মনে হয় ও সব ছোটখাটো অস্তরকে ভয় খাওয়ার পাত্র নয় হরুয়া, আরও একটা কথা বাপু, এত জিনিস থাকতে রাজা প্রতাপের ওই পেল্লায় শূল দিয়েই বা তোমার বামাচরণবাবু কী করবেন?”
জগা মাথা নেড়ে বলে, “আমিও জানি না, তবে বলছিলেন, শূলখানা পাচার করতে পারলে একদিন পেট পুরে ভুনি খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা খাওয়াবেন, ভুনি খিচুড়ি কখনও খেয়েছেন ঠাকুরমশাই?”
“এক-আধবার।”
“ওফ, সে রাজরাজড়ার ভোজ, তার সঙ্গে হাতাদুয়েক গরম ঘি হলে আর কথাই নেই, তা সেসব কথাও হয়েছে বামাচরণবাবুর সঙ্গে। পাঁপড়ভাজা হবে, ইলিশের ডিমের বড়া থাকবে, শেষ পাতে চাটনি আর দই।”
“এত কথাও হয়েছে নাকি?”
“আজ্ঞে। কথাবার্তা একেবারে পাকা।”
“কিন্তু শুলখানা যে সরাবে সেটা কিন্তু চুরির শামিল। চুরি করা কি ভাল কাজ হে জগা? অস্তরটা বরং তুমি বামাচরণবাবুকে ফেরত দিয়ে এসে গে। বলল, একাজ আমার দ্বারা হবে না।”
“তা হলে বাঘ মারব কী দিয়ে ঠাকুরমশাই? অস্তরটাকে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না তো ঠাকুরমশাই? তবে এই যে দেখুন–”
বলে পিস্তলটা তুলে জগা ঘোড়াটা টিপে দিল।
যে কাণ্ডটা হল, রসময় তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, বিকট একটা শব্দ আর সেইসঙ্গে আগুনের ঝলক তুলে একটা গুড়লের মতো জিনিস ছিটকে গেল, গাছ থেকে একটা কাক মরে পড়ে গেল বোধ হয় নীচে, পাখিরা তুমুল চিৎকার করতে লাগল। ভুলু লেজ গুটিয়ে কেঁউ-কেঁউ করতে লাগল, রসময় স্তম্ভনভাবটা কাটিয়ে নিয়েই লাফ মেরে পড়ে দৌড়তে লাগলেন। পেছনে পেছনে জগাও।
জগার হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়েছিল ঘাসের ওপর। কাকটা মরে পড়ে আছে একটা জামগাছের তলায়। রসময়ের লণ্ঠনের ম্লান আলোয় জায়গাটা ভুতুড়ে দেখাচ্ছে।