“না বাপু, শাস্ত্রে খিচুড়ির কথা পাইনি।”
“সেইটেই তো মুশকিল, সায়েন্সে খিচুড়ির কথা আছে মনে করে গোবিন্দর কাছে গিয়েছিলুম। তা সে বলল, খিচুড়িও আসলে ডালভাতই। শুনে এমন রাগ হল! এই বিদ্যে নিয়ে গোবিন্দ নাকি আবার কলেজে সায়েন্স পড়ায়। ছ্যাঃ ছ্যাঃ।”
“তা বাপু, খিচুড়ির কথাই শুধু ভাবলে চলবে কেন? ধরো দুধে চালে সেদ্ধ করলে পায়েস, আবার দুধেভাতে মাখলে দুধভাত। এটাই বা কেমন করে হচ্ছে?”
ভারী বিরক্ত হয়ে জগা বলল, “আহা, খিচুড়ির কথাটাই আগে শেষ হোক, তবে না পায়েসের কথা! আলটপকা খিচুড়ির মধ্যে পায়েস এনে ফেললে একটা ভজঘট্ট লেগে যাবে না?”
রসময় মাথা নেড়ে বললেন, “তা বটে, তা হলে খিচুড়ির কথাটাই শেষ করো বাপু, তারপর বাড়ি যাই।”
জগা বলল, “বাড়ি যাবেন যান, কিন্তু তা বলে খিচুড়ির কথাটা এখানেই শেষ করা যাচ্ছে না। এ-নিয়ে আরও ভাবতে হবে।”
সিঁড়ির নীচে ভুলু ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ একটু ভুকভুক আওয়াজ করল।
রসময় উঠতে-উঠতে বললেন, “না, আর রাত করা ঠিক হবে। মোহনপুরার জঙ্গলে নাকি বাঘের উৎপাত হয়েছে। জঙ্গলটা তো বেশি দূরেও নয়।”
জগা দাড়িগোঁফের ফাঁকে একছটাক হেসে বলল, “বাঘের খবরে ভয় পেলেন নাকি ঠাকুরমশাই?”
“বাঘকে ভয় না খায় কে বাপু?”
জগা মাথা নেড়ে বলল, “আমারও ভয় ছিল খুব। তবে নিত্যহরি কবরেজ অয়স্কান্তবাবুর বাতব্যাধির জন্য কী একটা ওষুধ বানাবেন বলে বাঘের চর্বি খুঁজছেন, তা আমি সেদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলুম, বাঘের চর্বি তো আর হাটে-বাজারে পাওয়া যাবে না, তা দামটা কীরকম দিচ্ছেন? নিত্যহরি কবরেজ পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে বলল, “বাপু রে, জোগাড় করে যদি দিতে পারিস তা হলে প্রতি সের পাঁচ হাজার টাকা দর দেব, ওই দর শুনেই ভয়ডর চলে গেল, সেই থেকে আমি জুতসই একটা বাঘ খুঁজে বেড়াচ্ছি। চর্বি তো নিত্যহরি নেবেই, বাঘের ছালেরও নাকি অনেক দাম, তারপর নখ-দাঁত সবই নাকি ভাল দামে বিক্রি হয়। একটা বাঘ জোগাড় হলে এখন দিনকতক বেশ পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খাওয়া যায়, কী বলেন?”
“তা হলে তো মোহনপুরার বাঘটার কপাল খারাপই বলতে হয়। তা বাপু, বাঘটাকে মারবে কী দিয়ে? শুধু হাতে নাকি?”
জগা গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না, অন্তর আছে।”
“বটে! তা হলে তো নিশ্চিন্ত। তা অন্তরটা কী? বন্দুক নাকি?”
খিকখিক করে খুব হাসল জগা, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “বন্দুক আবার একটা অন্তর!”
“তবে কি কামান?”
“সে আছে একটা জিনিস, বাঘ মারার অস্তর কিনব বলে শীতলাতলার হাটে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করছিলুম এই শনিবার, তা বাঘ মারব শুনে সবাই হাসে, কেউ মোটে আমলই দেয় না, আজকাল ফচকে লোকের সংখ্যা ক্রমেই বড় বাড়ছে, লক্ষ করেছেন কি ঠাকুরমশাই?”
“তা আর বলতে!”
“তাই বড্ড দমে গিয়েছিলুম। একজন তো বলেই ফেলল, ‘ও জগা, তুমি যে বাঘ মারতে চাও এ-খবরটা যদি বাঘের কানে পৌঁছে দিতে পারে তা হলে আর চিন্তা নেই। বাঘ হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে নিজেই মরে যাবে।’ বলুন তো ঠাকুরমশাই, এসব কথা শুনলে কার না রাগ হয়?”
“হ্যাঁ, তা রাগ তো হতেই পারে।”
“হরিখুড়ো কী বলল জানেন? বলল, বাঘ মারবে কী হে, ছ্যাঃ ছ্যাঃ। কথায় বলে মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার, বাঘ মারবে কোন দুঃখে! মারলে গণ্ডার মারো।”
“এ তো হরিখুডোর বড় অন্যায় কথা। গণ্ডারের চাইতে বাঘই। বা কম যায় কিসে!”
“সেকথা আর কে বুঝছে বলুন, শ্যামাপদবাবু তো আর এক কাঠি সরেস। বললেন কি, ওহে জগাভায়া, বাঘকে মারতে যাবে কোন দুঃখে? জ্যান্ত বাঘের যে অনেক বেশি দাম! এই তো নবীন সাহা লোহার কারবার করে সদ্য বড়লোক হয়েছে, হাতে অঢেল পয়সা। কুকুর, বেড়াল, গোরু, ঘোড়া পুষে অরুচি ধরেছে। এ বার বাঘ পোর শখ। লাখ টাকা দিয়ে কিনে নেবে। তুমি শুধু ধরে দাও।”
“বটে! ঠাট্টাই করল নাকি?”
“তা কে জানে! নবীনের পয়সা আছে, কথাটা মিথ্যে নয়। তবে ঠাকুরমশাই, কথাটা শুনে নিমাই যা বলল তা একেবারে ধ্যাষ্টামো। বলল কি, বাঘ ধরা তো সোজা ব্যাপার, হুইল বঁড়শিতে একটা পাটা গেঁথে ঝুলিয়ে দিয়ে গাছের ওপর বসে থাকো। বাঘ এসে কপাত করে পাঁটাকে গিললেই গেঁথে তুলে ফেলবে।’ শুনুন কথা, বাঘ যেন পুকুরের মাছ! বাঘকে কি অত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ভাল?”
“উঁহু, উঁহু, মোটেই ভাল নয়। ওতে বাঘ আরও কূপিত হয়ে
পড়েন, তা হলে তোমাকে নিয়ে হাটের মধ্যে একটা শোরগোলই পড়ে গিয়েছিল বোধ হয়?”
“যে আজ্ঞে, মেলা লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছিল। অমন একটা গুরুতর কথায় যে লোকে এমন হাসাহাসি করতে পারে তা জন্মে দেখিনি!”
“অন্যায় কথা, খুবই অন্যায় কথা।”
“আজ্ঞে, এইজন্যই তো দেশটার উন্নতি হল না।”
“তা যা বলেছ!”
“শুধু বামাচরণবাবুর মতো লোক দু-একজন আছে বলেই যা একটু ভরসা।”
রসময় অবাক হয়ে বলেন, “বামাচরণবাবুটা আবার কে?”
“তাঁকে আমিই কি চিনতুম নাকি? শীতলাতলার হাটেতেই চেনা হল। বড্ড ভাল লোক। সাঁঝের মুখে যখন ফিরে আসছি তখনই হঠাৎ লম্বানা একটা লোক এসে কাঁধে হাত দিয়ে খুব হাসি-হাসি মুখ করে বলল, ‘জগাভায়া কি কিছু খুঁজছ নাকি?’ আমি বললুম, আর বলবেন না মশাই, একটা অস্তর জোগাড় করতে এসে কী হেনস্থাটাই হল!’ তখন উনি বললেন, ‘সে আমি নিজের চোখেই দেখেছি, আমি এই পাশের গাঁয়েই থাকি, নাম বামাচরণ মিত্তির, তোমাকে বিলক্ষণ চিনি। সত্যি বলতে কী, তোমার মতো বুকের পাটাওলা লোক দুটি দেখিনি। বাঘটা আমাদের গাঁয়েও উৎপাত করছে খুব। পরশু রাতেই তো হেমবাবুর গোরুটা মারল, কিন্তু কেউই বাঘটা মারার জন্য কিছু করছে না। দারোগাবাবু সদাশিব আর শিকারি নাদু মল্লিকের ভরসায় সবাই বসে আছে। তা তারাও তো বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। দারোগা সদাশিব নাকি আজকাল গজল শিখছেন, গান নিয়েই ব্যস্ত। আর নাদু মল্লিকের নতুন নাতি হয়েছে। সেই নাতি নিয়েই আহ্বাদে মেতে আছেন, বন্দুক ছুঁয়েও দেখেন না। এখন ভরসা তুমি। কথাটা শুনে খুব সন্তুষ্ট হলুম। হ্যাঁ, এই একটা বিবেচক লোক, তো বললুম, “বাঘ মারব কিন্তু অন্তর কই? শুধু হাতে তো আর বাঘ মারা যায় না মশাই।’ তখন বামাচরণবাবু আমার কানে কানে বললেন, “অন্তরের অভাব হবে না, অভাব তো শুধু শিকারির, আমি তোমাকে মোক্ষম অস্তর দেব।”