“ওসব পিকনিক-টিকনিক এখানে হয় না। এ গাঁ-গঞ্জ জায়গা।”
পুটু বলল, “কিন্তু আমরা যদি যাই?” খাসনবিশ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “না যাওয়াই ভাল। সাপখোপ ছাড়াও অন্যসব জিনিস আছে।”
“কী জিনিস খাসনবিশদাদা?” খাসনবিশ মাথা চুলকে বলল, “তুমি তো আবার নাস্তিক। তোমাকে বলেও লাভ নেই।”
“তুমি নিশ্চয়ই বলবে, ওখানে ভূত আছে!”
“বলব বলব করছিলাম, তা তুমিই যখন বলে দিলে তখন সত্যি কথাটা স্বীকার করাই ভাল। এখানে ইদানীং ভূতের উৎপাত হয়েছে বলে শুনেছি।”
“আমি ভূতপ্রেত মানি না।”
খাসনবিশ খিঁচিয়ে উঠে বলল, “তা মানবে কেন? দু’পাতা সায়েন্স পড়ে তোমরা সব গোল্লায় গেছ। তবে কুনকে তো আর মিছে কথা বলার ছেলে নয়!”
“কুনকে আবার কে?”
“কুণ্ডবাড়ির ছেলে কনিষ্ক কুণ্ডু, ক্লাসে ফার্স্ট হয়। সে আর পালপাড়ার ভোলা দু’জনেই স্বচক্ষে দেখে এসেছে।”
“কী দেখেছে খাসনবিশদাদা?”
“তা আর তোমাকে বলে কী হবে? বিশ্বাস তো আর করবে!”
“ভূতের গল্প শুনতে যে আমার ভীষণ ভাল লাগে!”
“গল্প? হুঁ, তোমার কাছে গালগল্প হলেও যারা দেখেছে তাদের কাছে তো নয়।”
“না বললে কিন্তু তোমার তামাক-টিকে চুরি করে লুকিয়ে রাখব।”
চোখ কপালে তুলে খাসনবিশ বলে, “ও বাবা, তুমি যে দেখছি গুটকের চেয়েও বেশি বিচ্ছু!”
“গুটকেটা তো হাঁদারাম, সাইকেল চালাতে পারে না।”
“তা না পারুক, গুটকে সাঁতার জানে। তুমি জানো?”
“ও আমি দু’দিনে শিখে নেব। এবার গল্পটা বলল। কুনকে আর ভোলা কী দেখেছিল?”
“কুনকে খুব হামাদ ছেলে, ভয়ডর বলতে কিছু নেই, বুঝলে!”
“সে আমারও নেই। তারপর বলো।”
“কথাই তো কইতে দাও না, কেবল ফুট কাটো। হ্যাঁ, তা হয়েছে কী গতবার শীতের শুরুতেই তারা দুজন এক দুপুরবেলা একটা ডিঙি নৌকো বেয়ে ওই দ্বীপে গিয়েছিল।”
“ওরা নৌকো বাইতে পারে বুঝি?”
“পারবে না? গাঁয়ের ছেলেরা সব পারে। তোমাদের শহুরে ছেলেদের মতো তো নয়।”
“আমিও দু’দিনে শিখে নেব। তারপর বলো।”
“তা তারা গিয়েছিল বেজির বাচ্চা খুঁজতে।”
“ওখানে বেজি আছে বুঝি?”
“প্রতাপরাজার আমলে মেলাই ছিল। উনি খুব বেজি পছন্দ করতেন। তা সেইসব বেজি এখন ঝাড়েবংশে বেড়েছে হয়তো।”
“এই যে বললে ওখানে সাপখোপের আড্ডা! বেজিরা তো সাপগুলোকে মেরেই ফেলবে।”
“ওরে বাবা, জঙ্গলের নিয়ম কি আর আমাদের মত? সেখানে সবাই থাকে। ঝগড়াঝাঁটি খুনখারাপি হয়, আবার থাকেও একসঙ্গে। সাপও আছে, বেজিও আছে। তা সেইখানে গিয়ে যখন জঙ্গলের মধ্যে দু’জনে বেজি খুঁজছিল সেই সময়ে হঠাৎ দেখতে পায় একটা খুব লম্বা লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
“সেটাই কি ভূত?”
“আঃ, ফের কথা বলে! হ্যাঁ বাপু, সেটাই ভূত।”
“যাঃ, লম্বা লোক হলেই বুঝি ভূত হয়? তা হলে আমার নসু কাকাও তো ভূত।”
“ওরে বাপু, লম্বার তো একটা বাছবিচার আছে! তিন-চার হাত লম্বা হলে কথা ছিল না, এ-লোকটা যে সাত-আট হাত লম্বা।”
“তার মনে কত ফুট?”
“তা ধরো দশ বারো ফুট তো হবেই।”
“গুল মারছ খাসনবিশদাদা।”
“এইজন্যই তোমাকে কিছু বলতে চাই না।”
“দশ বারো ফুট লম্বা কি মানুষ হয়?”
“মানুষ হলে তবে তো?”
“তা সে-লোকটা কী করল?”
“কী আবার করবে? লোকটা একটা নারকোল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চেয়ে ছিল। ওরা কি আর কিছু দেখেছে? ওরকম ঢ্যাঙা একটা লোককে দেখেই পড়ি কি মরি করে দৌড়ে এসে ডিঙিতে উঠে পালিয়ে এসেছে।”
“দুপুরবেলা?” “হ্যাঁ, ঠিক দুপুরবেলা। কথাতেই তো আছে, ঠিক দুকুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।”
২. বিদ্যাধরপুর গাঁয়ের একটু তফাতে
বিদ্যাধরপুর গাঁয়ের একটু তফাতে জঙ্গলের মধ্যে বুড়ো শিবের পুরনো মন্দির। মন্দিরের গায়ে ফাটল ধরে তাতে অশ্বথের চারা উঁকি মারছে, দেওয়ালে শ্যাওলার ছোপ, তক্ষকের বাসা। আজকাল লোকজনও বিশেষ আসে না। শুধু জগাপাগলা আর ভুলু কুকুর রোজ সন্ধেবেলা হাজির থাকে।
প্রৌঢ় পুরোহিত রসময় চক্রবর্তী সন্ধ্যাপূজা সেরে বেরিয়ে এসে দেখেন জগাপাগলা চাতালের ওপর নিজের ঝোলাটাকে তাকিয়ার মতো করে আধশোওয়া হয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। আর চাতালের সিঁড়ির নীচে ভুলু মহা আরামে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছ।
রসময় চক্রবর্তী লণ্ঠনটা পাশে রেখে চাতালে বাবু হয়ে বসলেন। জগাপাগলার সঙ্গে রোজই তাঁর কিছু কথাবার্তা হয়। লোকটা পাগল হলেও তাকে খারাপ লাগে না চক্কোত্তি মশাইয়ের।
শরৎকাল এসে গেছে। এ-সময়ে সন্ধের পর একটু হিম পড়ে। জগার গায়ে একটা সবুজ রঙের গরম কাপড়ের কোট, আর পরনে কালো পাতলুন। রসময় লক্ষ করলেন, পোশাকটা বেশ নতুন।
“আজ কী নিয়ে ভাবনায় পড়লে হে জগা? বড্ড তন্ময় দেখছি যে!”
জগা সোজা হয়ে বসে গোঁফদাড়ির ফাঁক দিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, “আজ্ঞে, বড় সমস্যায় পড়ে গেছি।”
“কী নিয়ে সমস্যা?”
“আজ্ঞে, খিচুড়ি নিয়ে।”
“খিচুড়ি? সে তো ভাল জিনিস। সমস্যাটা কোথায়?”
“সমস্যা আছে। ধরুন চালেডালে মিশিয়ে সেদ্ধ করলে তো খিচুড়ি হয়, না কি?”
“তা বটে।”
“কিন্তু ডালভাত মাখলে তো তা হচ্ছে না।”
“না, তা হচ্ছে না।”
“ওইখানেই তো সমস্যা। চালেডালে সেদ্ধ করলে খিচুড়ি, আর চাল আলাদা ডাল আলাদা সেদ্ধ করলে ডালভাত, এটা কেন হচ্ছে বলুন তো ঠাকুরমশাই?”
“ও বাবা, এ তো জটিল প্রশ্ন দেখছি।”
“খুবই জটিল। যত ভাবছি তো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কেউই কোনও সমাধান দিতে পারছে না। আপনি তো মেলাই শাস্ত্রটাস্ত্র জানেন, আপনি বলতে পারেন না?”