গগনবাবু টর্চ না জ্বেলেই ভাঙাচোরা রাস্তায় খোয়া, পাথর আর জঙ্গল ভেদ করে দরজাটার কাছে পৌঁছলেন। খুব সন্তর্পণে দরজাটা টানতেই ক্যাচ করে সামান্য ফাঁক হল।
গগনবাবু একটু অপেক্ষা করলেন। তারপর ফের খুব সন্তর্পণে দরজাটা আবার টানলেন। আবার কাঁচ করে শব্দ। তবে মানুষ গলে যাওয়ার মতো পরিসর সৃষ্টি হল। প্রথমে মাথা নিচু করে গগনবাবু এবং পেছনে তিনজন ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকলেন। সামনে জমাট অন্ধকার।
গগনবাবু ফিসফিস করে বললেন, “আলো জ্বালাবেন না। আমার পিছু পিছু আসুন। সামনে তিন ধাপ সিঁড়ি আছে। তারপর হলঘর। হলঘর পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি।
হলঘর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে অনেক সময় লাগল। সব কাজই করতে হচ্ছিল সন্তর্পণে। তা ছাড়া পুরনো ভাঙা বাড়িতে ইট-কাঠ-আবর্জনা এত জমে আছে যে, পা রাখাই দায়!
দোতলার চাতালে বুকসমান ইট-বালি-সুরকি জমে আছে। ভাঙা ছাদের একটা অংশ খসে পড়েছে এখানে। কোথায় যেন একটা তক্ষক ডেকে উঠল।
চাপা গলায় গগনবাবু বললেন, “ডাইনে। সাবধান, এখানে একটা জায়গা ভেঙে পড়ায় ফাঁক হয়ে আছে।”
এগোতে বাস্তবিকই কষ্ট হচ্ছিল। গগনবাবুর মিলিটারি ট্রেনিং আছে, আর কারও তা নেই।
অন্তত বিশ কদম গিয়ে ডানধারে একটা দরজার কাছে দাঁড়ালেন গগনবাবু। ঘরের ভেতরে ঘটাং-ঘটাং করে দুটো শব্দ হল। লোহার গায়ে লোহার শব্দ।
গগনবাবু সন্তর্পণে মুখটা বের করে দেখলেন, মস্ত শুলটা দেওয়ালের এক জায়গায় ঢোকানোর চেষ্ট করছে দুটো লোক। তাদের একজন খুব, খুবই লম্বা। অন্তত সাড়ে সাত ফুট হবে।
হঠাৎ জলদগম্ভীর স্বরে গগনবাবু বলে উঠলেন, “ক্ষেত্ৰী, আমি তোমাকে গ্রেফতার করতে এসেছি।”
সঙ্গে-সঙ্গে ভেতরে ঠঙাত করে বিকট শব্দ হল। শুলটা ফেলে দিল হয়তো। আর তারপরেই ট্যারারারা… ট্যারা রারা… ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসতে লাগল খোলা দরজা দিয়ে।
রসময় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। মদন হাজরা বাপরে বলে চিৎকার দিয়ে, সিঁড়ির দিকে দৌড়তে গিয়ে ইট-বালির স্তূপে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। গুলবাগ দেওয়ালে সেঁটে দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে দুগা দুর্গতিনাশিনী’ জপ করতে লাগল।
শুধু অচঞ্চল গগনবাবু ঘাবড়ালেন না। পায়ের কাছ থেকে একটা আধলা ইট তুলে নিয়ে গুলির মুখেই আচমকা দরজা দিয়ে ভেতরে সজোরে ছুঁড়ে মারলেন।
গুলির শব্দ থামল। ভেতরে কে যেন একটা কাতর আর্তনাদ করে ধপাস করে পড়ে গেল।
গগনবাবু ঘরে ঢুকে টর্চ জ্বাললেন।
দেখা গেল লম্বা লোকটা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নামছে। দ্বিতীয় লোকটা হাতে পিস্তল নিয়ে বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
গগনবাবু স্টেনগানটা তুলে গুলির ম্যাগাজিনটা খুলে নিলেন। তারপর দ্বিতীয় লোকটার দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, “কী ক্ষেত্ৰী, গুলি করবে নাকি? তা চালাও দেখি গুলি, কেমন পারো দেখি।”
ক্ষেত্ৰী পিস্তল তুলল, ট্রিগারে আঙুল রাখল, তারপর দাঁতে দাঁত চাপল, চোখ বুজল। কিন্তু গুলি করতে পারল না। তার হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। শেষে সে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, “না, পারছি না! পারছি না।”
গগনবাবু এগিয়ে গিয়ে তার হাতের পিস্তলটা তুলে নিলেন। লোকটা বাধা দিল না।
দৃশ্যটা দেখে রসময় অবাক! হাতে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও ক্ষেত্রী কেন গগনবাবুকে গুলি করল না সেটা বুঝতে পারলেন না তিনি।
গগনবাবু হাঁক দিলেন, “গুলবাগ সিং!”
গুলবাগ এবার বুক চিতিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, “বলুন সার।”
“এই ঢ্যাঙা লোকটার হাতে হাতকড়া পরাও।”
“বহুত আচ্ছা সার।” বলে গুলবাগ পটাং করে লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে বলল, “আর উনি?”
গগনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “একে পরাতে হবে না।” তারপর ক্ষেত্রীর দিকে ফিরে গগনবাবু শুধু বললেন, “বিশ্বাসঘাতক! কাপুরুষ!”
মাঝবয়সী, গাঁটাগোট্টা চেহারার ক্ষেত্ৰী নামের লোকটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
বন্দুক-পিস্তলের মাঝখানে রসময় বড়ই অস্বস্তি বোধ করছেন। তবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “গগনবাবু, আপনার বড় দুঃসাহস। ওভাবে পিস্তলের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আপনার উচিত হয়নি। লোকটা গুলি করলে কী যে হত।”
গগনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “রামলাল ক্ষেত্রীকে আপনি যদি চিনতেন তা হলে ওর পিস্তলের সামনে দাঁড়াতে আপনারও ভয় করত না।”
মদন হাজরা গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিলেন। বললেন, “লোকটা কে গগনবাবু?”
“মিলিটারিতে আমার ব্যাটালিয়নেই চাকরি করত। কিন্তু ও একটি অদ্ভুত সাইকোলজিক্যাল কেস। মিলিটারি হয়েও জীবনে কোনওদিন কাউকে মারতে পারেনি, এমনকী, যুদ্ধের সময়েও না, মানুষ মারা তো দূরে থাক, একবার ফাঁদে পড়া একটা ইঁদুরকে মেরে ফেলতে বলেছিলাম ওকে। তাও পারেনি। তা বলে ওকে খুব অহিংস ভাববেন না যেন। নিজে মারতে পারে না বটে, কিন্তু অন্যকে দিয়ে খুন করাতে ওর আপত্তি তো নেই-ই, বরং আগ্রহ আছে। খুনখারাপি বরং ও ভালইবাসে এবং তা ঘটানোর জন্য সব আয়োজন করে দেয়। শুধু নিজে হাতে কাজটা করে না। যদি তা পারত তবে অনেক আগেই আমাদের উড়িয়ে দিত। সেটা পারেনি বলেই ও জগাপাগলাকে কাজে লাগিয়েছিল।”
“কিন্তু ওই ঢ্যাঙা লোকটা তো ছিল।”
ঢ্যাঙা লোকটা থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। গগনবাবু তার দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “একেও আমার খুব বলবান বা সাহসী বলে মনে হচ্ছে না। বরং সন্দেহ হচ্ছে, পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের গণ্ডগোলে হঠাৎ ঢ্যাঙা হয়ে গিয়ে অসুবিধেয় পড়ে গেছে শরীরটা নিয়ে। কী হে ক্ষেত্ৰী, ঠিক বলছি?”