লোকটা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই দৌড়ে পালিয়ে গেলে পুটু উঠে মাংসের টুকরোটা তুলে দেওয়ালের বাইরে ফেলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল হল, রাস্তার কুকুররা বা কাকটাকেরা যদি খায়?
বিকট শব্দে বাড়িসুদ্ধ নোক উঠে পড়েছে। গগনবাবু বেরিয়ে এসে থমথমে মুখ করে সংক্ষেপে ঘটনাটা শুনে নাতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ বটে, কিন্তু খুব বিপদের ঝুঁকি নিয়েছ। খাসনবিশের বদলে আমাকে ডেকে নিলেই পারতে! তোমার হাতে ওটা কী?”
“এটা মনে হচ্ছে বিষ-মেশানো মাংস। লোকটা টমিকে দিতে চাইছিল।”
“সর্বনাশ! ওরে খাসনবিশ, ওটা মাটিতে পুঁতে ফেল তো এক্ষুনি।”
খাসনবিশ দৌড়ে শাবল এনে বাগানের কোণে মাংসের টুকরোটা পুঁতে দিয়ে এল।
গগনবাবু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ব্যাপারটায় তোমরা ভয় পেয়েছ জানি। বোমার পর স্টেনগান। কেউ আমাকে দুনিয়া থেকে সরাতে চাইছে। কেন চাইছে তা বুঝতে পারছি না। তবে একটা সন্দেহ আমার হচ্ছে। যদি সেই সন্দেহ সত্য হয় তবে বেশ গণ্ডগোলের ব্যাপার।”
ঠিক এই সময়ে রসময় এসে ঢুকলেন। থরথর করে কাঁপছেন। মুখে কথা সরছে না।
গগনবাবু একটু হেসে বললেন, “আসুন ঠাকুরমশাই, মনে-মনে আপনাকেই খুঁজছি। আমার একজন বিচক্ষণ লোক দরকার।”
রসময় কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বললেন, “বেঁচে যে আছেন এই ঢের। দুগা, দুর্গা।”
“লোকটা কে ঠাকুরমশাই? চেনেন?”
রসময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চিনি। ও হল জগাপাগলা।”
গগনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “জগাপাগলা! বলেন কী ঠাকুরমশাই?”
“ঠিকই বলছি। তবে ওর দোষ নেই। পেছনে অন্য লোক আছে।”
“কে লোক?”
“কখনও তার নাম বামাচরণ, কখনও পরেশবাবু। কিন্তু হাতে আর সময় নেই গগনবাবু। এখনই একবার রাজবাড়ির দিকে যাওয়া দরকার।”
গগনবাবু হঠাৎ টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “শূল! অ্যাাঁ! শূলটা নিয়ে যাবে না তো! চলুন তো, দেখি!”
.
ভূত-যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে জগা খুব হাসছিল। গগনবাবুর বাড়ির আশপাশে মেলা ভূত ছেড়ে এসেছে আজ। আর ভূতগুলোর কী তেজ বাপ! আগুনের ঝলক তুলে রে-রে ৭২
করতে করতে সব বেরোতে লাগল। গগনবাবুর ঘরের মধ্যে ছাড়তে পারলে ভাল হত। লোকটা বড় ছ্যাঁচড়া। মেয়ের বিয়েতে জগাকে মোটেই ভাল করে খেতেই দিল না! যা হোক, বাড়ির সামনে যে ভূতগুলো জগা ছেড়ে এল তারা কি আর গগনবাবুকে ছেড়ে কথা কইবে?
নষ্টের গোড়া ওই ছেলেটা এসে যে পিড়িং করে কী একটা জিনিস ছুঁড়ে মারল! জগার কপালের ডানদিকটা এখন ফুলে বড্ড টনটন করছে। রক্তও পড়ছে বটে। তবে আনন্দটাও তো হচ্ছে। কম নয়। শক্ত শক্ত কাজ করতে ভারী আনন্দ হয় জগার।
রাজবাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পড়েছে তখন কে যেন তার পাশে-পাশে দৌড়তে লাগল। সেই ভূতগুলোর একটা নাকি? অন্ধকারে আবছায়ায় তাই তো মনে হচ্ছে!
জগা চোখ পাকিয়ে বলল, “যাঃ, যাঃ, এখানে কী? যেখানে ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে দাপাদাপি কর।”
ভূতটা বেশ বিরক্ত গলায় বলল, “এবারও পারলে না তো?”
“পরেশবাবু যে! ও, ভূত যা ছেড়ে এসেছি আর দেখতে হবে। এতক্ষণে ভূতেরা দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দিয়েছে গিয়ে দেখুন গগনবাবুর বাড়িতে।”
পরেশবাবু বললেন, “মোটেই তা নয় জগা। ভূতগুলো সব মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।”
জগা অবাক হয়ে বলল, “বলেন কী মশাই? মুখ থুবড়ে তো পড়ার কথা নয়!”
পরেশবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার ওপর বড় ভরসা ছিল হে! এ-গাঁয়ে তোমার মতো বীর আর কে?”
“আজ্ঞে, সে তো ঠিক কথা।”
“নিজে পারলে অবশ্য তোমাকে কষ্ট দিতাম না। কিন্তু ওইখানেই যে মুশকিল। নিজে হাতে মশা-মাছিটা অবধি মারতে পারি না আমি। সেইজন্যই তো চাকরিটা ছাড়তে হল।”
জগা কথাটার প্যাঁচ ধরতে পারল না। তবে হাসির কথা ভেবে খুব হাসল। বলল, “মশা-মাছি আমি খুব মারতে পারি।”
রাজবাড়ির দেউড়ির উলটো দিকে জগাকে নিয়ে ঠেলে দাঁড় করিয়ে পরেশবাবু বললেন, “এবার যেন ভুল না হয়, দেখো।”
জগা বলল, “না, না ভুল হবে কেন? সোজা কাজ। তবে কাজটা যেন কী পরেশবাবু?”
“ওই যে দেউড়ির বাইরে হরুয়া আর রামুয়া দু’ভাই পাহারা দিচ্ছে দেখেছ? দুজনের হাতেই পাকা বাঁশের লাঠি।”
“ও আর দেখব কী? রোজ দেখছি।”
“তা হলে এবার এগিয়ে যাও। একেবারে কাছাকাছি গিয়ে যন্ত্রটা ভালমতো তাক করে ভূতগুলো ছেড়ে দিয়ে এসো। এবার যেন আর কাজ পণ্ড করে দিয়ো না।”
“না, না, আর ভুল হবে না। তা এর পর আরও শক্ত শক্ত কাজ দেবেন তো পরেশবাবু?”
“মেলা কাজ পাবে। কাজের অভাব কী?”
জগা খুশি হয়ে বলল, “কেউ কাজ দেয় না মশাই, তাই বসে থেকে-থেকে আমার গতরে শুয়োপোকা ধরে গেল। এইসব কাজকর্ম নিয়ে থাকলে সময়টা কাটেও ভাল।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার যাও, কাজটা উদ্ধার করে এসো।”
“যে আজ্ঞে!”
ভূত ছাড়া ভারী মজার কাজ। জগা ভূত-যন্ত্রটা বগলে নিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেল। কাজ খুবই সোজা। দেউড়ির মাথায় একটা ডুম জ্বলছে। সেই আলোয় হরুয়া আর রামুয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
জগা যন্ত্রটা তুলে ঘোড়া টিপে ধরল। আর সঙ্গে সঙ্গেই আগুনের ঝলক তুলে রাশি রাশি ভূত ছুটে যেতে লাগল হরুয়া আর রামুয়ার দিকে। ভূতগুলোর কী তেজ! কী শব্দ! বাবা রে! যন্ত্রটা তার হাতের মধ্যে লাফাচ্ছে যেন!
দেউড়ির আলোটা চুরমার হয়ে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। ঝপঝপ করে কী যেন খসে পড়ল। হরুয়া আর রামুয়া বিকট চিৎকার করে উঠল, “বাপ রে! গেছি রে।”