এই নিয়ে একটা তর্কও বেধে উঠল বেশ। রামহরিবাবু বললেন, “এ, খুব ঢ্যাঙা দেখালেন মশাই! শিবরাম নস্করকে
আমিও চিনি। ও আবার লম্বা নাকি? অজিত কুণ্ডুকে তো দেখেননি। বাজিতপুরে বাড়ি। সেও হাটে আসে মাঝে-মাঝে। শিবরাম তো তার কোমরের কাছে পড়বে।”
মনসাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু উঁহু, অজিত কুণ্ডু লম্বা বটে, কিন্তু সাতকড়ির কাছে কিছু নয়। পয়সাপোঁতা গাঁয়ের সাতকড়ি গো, আমাদের শিবগঞ্জের শিবেনের জামাই। সে তো হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে নারকেল পারতে পারে, গাছে উঠতে হয় না।”
ব্যোমকেশবাবু টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, “কথাটা লম্বা নিয়ে নয়, ভূত নিয়ে। কথা হল, বাতাসা দ্বীপে একটা ঢ্যাঙ। ভূতের কথা শোনা যাচ্ছে। যারা মাছ-টাছ ধরতে যায় তারা নাকি দেখেছে। তা গাঁয়েগঞ্জে এরকম ভূত দেখা নতুন কিছু নয়। এসব কুসংস্কার ভেঙে ফেলা দরকার।”
রামহরি খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আপনি কি বলতে চান ভূত নেই!”
ব্যোমকেশবাবু বুক চিতিয়ে বললেন, “নেই-ই তো।”
“তা হলে বলি, আপনার বিজ্ঞান-পড়া বিদ্যে দিয়ে ওসব বুঝতে পারবেন না। সাহস থাকলে নীলগঞ্জে প্রতাপরাজার বাগানবাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে আসুন, বিজ্ঞান ভুলে রাম নাম নিতে পথ পাবেন না। শুনেছি সেখানে প্রতি রাতে ভূতের জলসা হয়। গানাদার বাজনদার ভূতরা সব আসে।”
“ওঃ, যত্ত সব।” বলে ব্যোমকেশবাবু রাগ করে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
তা সে যাই হোক, বয়স্ক মানুষদের ঝগড়া শুনতে পুটুর খুব ভাল লেগেছিল আজ। সে হিহি করে হাসছিল। কিন্তু দাদুর মুখে হাসি নেই।
মহেশবাবু ভালমানুষ। তিনি কোনও ঘটনার খারাপ দিকটা দেখতে পছন্দ করেন না। বললেন, “আচ্ছা, ধরুন, এমনও তো হতে পারে, বিদ্যাধরপুরের ওপর দিয়ে নিশুত রাতে পথ ভুলে কোনও এরোপ্লেন যাচ্ছিল। ধরুন, প্লেনের পাইলটের খুব ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। সে হয়তো ঘুম চোখে বোমা ফেলার বোতামটা টিপে দিয়েছিল। ঘুম চোখে ভুল তো হতেই পারে। আর সেই বোমাটাই এসে গগনবাবুর বাগানে পড়েছে। হয়তো বোমাটা মেঘের ভেতর দিয়ে আসার সময় ভিজে সেঁতিয়ে গিয়েছিল, তাই আমাদের ভাগ্যে ফাটেনি। হতে পারে না এরকম?”
রামহরিবাবু বললেন, “হতে পারবে না কেন? তবে হয়নি।”
গগনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “এরোপ্লেন থেকে এ ধরনের বোমা ফেলা হয় না মহেশবাবু।”
দাদুর মুখে একটুও হাসি না দেখে আজ পুটুর মনটা বড্ড খারাপ লাগছিল। গাঁয়ের লোকেরা বিদেয় হলে সে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি এত ভাবছ কেন দাদু? কী হয়েছে?”
গগনবাবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “অনেক কথা ভাবছি দাদু। একটা গভীর ষড়যন্ত্র। নইলে প্রতাপরাজার শুলটা হাতাতে চাইবে কেন? বুঝলে ভাই, আমার মনটা আজ সত্যিই ভাল নেই।”
রাতে যখন পুটু খেয়েদেয়ে মায়ের পাশে শুতে গেল, তখনও দাদুর গম্ভীর মুখটা সে ভুলতে পারছে না। বিদ্যাধরপুরে এলে দাদুই তার সারাদিনের সঙ্গী। কত গল্প হয়, হাসিঠাট্টা হয়, খেলা হয় দাদুর সঙ্গে। কিচ্ছু হচ্ছে না সকাল থেকে।
পুটু হয়তো ঘুমিয়েই পড়ত, কিন্তু সাঁতার কেটে আজ তার হাত-পায়ে খুব ব্যথা। মা ঘুমিয়ে পড়ার পরও সে অনেকক্ষণ জেগে রইল। তারপর ভাবল, উঠে বরং বাড়িটা পাহারা দিই।
সে গিয়ে প্রথমেই খাসনবিশকে জাগাল, “ও খাসনবিশদাদা, ওঠো! ওঠো!”
খাসনবিশ প্রথমটায় উঠতে চায় না। ঠেলাঠেলি করায় হঠাৎ একসময়ে জেগে সটান হয়ে বসে বলল, “কী! কী! হয়েছেটা কী? আবার বোমা নাকি? উরেব্বাস! আবার বোমা! নাঃ, এবার আমি বৃন্দাবন চলে যাব!”
পুটু হিহি করে হেসে বলল, “ভয় পাচ্ছ কেন? এবার কেউ বোমা ফেলতে এলে এই দ্যাখো আমার পিস্তল। ঠাঁই করে গুলি চালিয়ে দেব।”
নিজের এয়ার পিস্তলটা তুলে খাসনবিশকে দেখাল পুটু। খাসনবিশ বলল, “ওরে বাবা, এয়ার পিস্তল দিয়ে কি আর ওদের ঠেকানো যাবে?”
পুটু খাসনবিশকে ঘুমোতে দিল না। জোর করে বাড়ির বারান্দায় এসে দুটো চেয়ারে বসল দুজনে।
“একটা ভূতের গল্প বলো তো খাসনবিশদাদা।”
খাসনবিশ একটা হাই তুলে গল্পটা সবে ফাঁদতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময়ে, টমি কুকুরটা ঘাউ-ঘাউ করে গেটের দিকে তেড়ে গেল।
খাসনবিশ আঁতকে উঠে বলল, “ওই রে! এসে গেছে বোমারু!”
পুটু ভয় খেল না। পিস্তলটা তুলে সে চেয়ার থেকে নেমে গেটের কাছে ছুটে গিয়ে আবছা অন্ধকারে একটা লোককে দেখতে পেল।
লোকটা একটা ছোট বন্দুকের মতো জিনিস বাগিয়ে ধরে আছে। অন্য হাতে একটা কী জিনিস দোলাতে-দোলাতে টমিকে বলছে, “আয়, আয়, খাবি আয়।”
গোয়েন্দা-গল্পে কুকুরকে বিষ-মেশানো খাবার খাওয়ানোর গল্প অনেক পড়েছে পুটু। সে চেঁচিয়ে উঠল, “এই তুমি কে? কী চাই?”
লোকটা ভয় পেল না। বলল, “রোসো বাপু, রোসো। অত চেঁচামেচি কোরো না। আমি ভূত ছাড়তে এসেছি। অনেক শক্ত কাজ আছে হাতে। আগে এই মাংসের টুকরোটা তোমাদের কুকুরটাকে খাওয়াতে হবে। তারপর ভূত ছাড়তে হবে। তারপর আরও আছে।”
বলে লোকটা টমির দিকে মাংসের টুকরোটা ছুঁড়ে দিতেই পুটু চেঁচাল, “অ্যাই খবর্দার!”
বলেই সে তার পিস্তল চালিয়ে দিল।
“বাপ রে! মরে গেলুম রে!” বলে লোকটা চেঁচাতে শুরু করতেই চারদিক প্রকম্পিত করে লোকটার হাতের বন্দুকটা থেকে ফুলঝুরির মতো গুলি ছুটতে লাগল।
পুটু দাদুর কাছে মিলিটারির অনেক কায়দা শিখে নিয়েছে। গুলি চলতেই সে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আর টমি ভয় পেয়ে ভীষণ চেঁচাতে লাগল।