জগা একটু ক্ষুব্ধস্বরে বলল, “কেন, শুলটা নিয়ে গিয়ে দুধসায়রের দ্বীপে রেখে আসতে হবে না? বামাচরণবাবুর সঙ্গে সেরকমই তো কথা ছিল।”
“না, না, সেসব আমিই করব’খন।”
“তা হলে কাজটা যে বেজায় সোজা হয়ে যাচ্ছে!”
পরেশবাবু একটু চিন্তিত হয়ে বলেন, “আচ্ছা, ভেবে দেখব’খন।”
“ভাবাভাবির কী আছে পরেশবাবু? পটল জেলের নৌকোটা ঘাটে বাঁধাই থাকে। শুলটা নৌকোয় চাপিয়ে বৈঠা মেরে পৌঁছে দেব’খন।”
পরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর দেরি করা ঠিক হবে না হে জগা। রওনা হওয়া যাক।”
“এই যাচ্ছি। আচ্ছা পরেশবাবু, আপনি লম্বা না বেঁটে?”
“কেন বলো তো?”
“ঠাকুরমশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন। তা আমি বললুম, বেঁটে। কিন্তু উনি বলছেন, লম্বা। কোনটা ঠিক?”
“তোমার কথাই ঠিক। আমি বেজায় বেঁটে। তা হলে এবার বেরিয়ে পড়ো হে।”
“যে আজ্ঞে।” বলে যন্ত্র হাতে নিয়ে জগা রওনা হতেই পরেশবাবু টপ করে ঝোলা থেকে বোমাটা বের করে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
আরও মিনিটদশেক বাদে হাঁফাতে-হাঁফাতে রসময় এসে হাজির হলেন। একটু দেরিই হয়ে গেছে তাঁর। লোকটা তাঁকে ভুলিয়েভালিয়ে মেঠো রাস্তায় অনেকদূর নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল। আচমকাই রসময়ের খেয়াল হল, এটা একটা কৌশল নয় তো! তাঁকে বেকায়দায় ফেলে অন্যদিকে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মতলব। বুঝতে পেরেই তিনি আর দাঁড়াননি। তবে পথে কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়ে এবং রাস্তা ভুল করে একটু সময় বেশিই লেগে গেল।
রসময় জগাকে তার বিছানায় না দেখে আশপাশে খুঁজলেন। লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে অনেকক্ষণ নিভে গেছে। অন্ধকারে কোথায় আর খুঁজবেন!!
বেশ কয়েকবার, “জগা, জগা!” বলে হাঁক মারলেন। কারও সাড়া পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি গিয়ে জগার ঝোলাটায় হাত ভরে দেখলেন, বোমাটাও নেই।
কপাল চাপড়ে রসময় আপনমনেই বললেন, “নিয়তি কেন বাধ্যতে।”
সঙ্গে-সঙ্গে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল রসময়ের পায়ের কাছে।
মদন হাজরা বলে উঠলেন, “কী শ্লোকটা বললেন ঠাকুরমশাই?”
“এই আজ্ঞে বলছিলুম কি, নিয়তি কেন বাধ্যতে।”
“আহা হা, অপূর্ব! অপূর্ব! এইসব ভাল-ভাল কথা ছাড়া কি আপনাকে মানায়! লাখ কথার এক কথা। আমিও তো তাই বলি, ওরে পাপীতাপীরা, নিয়তি কেন বাধ্যতে। তোদের নিয়তিই তোদের খাবে রে বাপু! তবে কেন যে আমাদের এত হয়রান করিস, এত দৌড়ঝাঁপ করাস, হেদিয়ে মারিস, তা বুঝি না বাবা। ঠিক নয় ঠাকুরমশাই?”
“আজ্ঞে, আপনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, আপনার মুখ থেকে কি ভুল কথা বেরোতে পারে?”
“তা আপনার জগা কোথায়? “সেটাই তো সমস্যা। তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
“তার মানে! সে গেল কোথায়?”
রসময় সরু গলায় বললেন, “বড়বাবু, আমার মনটা বড় কু গাইছে।”
“কু গাইছে! তার মানে কী?”
“আজ্ঞে, খারাপ কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে।”
“ওঃ তাই বলুন! আমি ভাবলাম এই রাতে আপনার বুঝি গানবাজনার শখ হল। কিন্তু কু গাইছে কেন?”
“আজ্ঞে, আমি বড় ভিতু মানুষ, আপনার মতো ডাকাবুকো নই। তো! অল্পেই বড় ঘাবড়ে যাই। তা ইয়ে, জগার ঝোলার মধ্যে বোমাটাও নেই।”
“অ্যাঁ! তা হলে কি সে বোমা নিয়ে খুনখারাপি করতে বেরিয়ে পড়েছে? এ তো বিপদের কথা হল মশাই! ওরে, তোরা সব চারদিকে ছড়িয়ে পড়, জগাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”
সেপাইরা তাড়াতাড়ি যে যেদিকে পারে দৌড় লাগাল।
মদন হাজরা রসময়ের দিকে চেয়ে বললেন, “আচ্ছা ঠাকুরমশাই, ভূত বলে কি কিছু আছে?”
রসময় অবাক হয়ে বলেন, “আজ্ঞে, কখনও দেখিনি। তবে আছে বলেই তো শুনি। কেন বলুন তো বড়বাবু?”
মদন হাজরা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি ভূতটুতে মোটেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু কয়েকটা ছেলে গতকাল বাতাসা দ্বীপে পেয়ারা পাড়তে গিয়েছিল। সেখানে নাকি তারা একটা লম্বা সাদা ভূত দেখে ভয়ে পালিয়ে আসে। এদের মধ্যে আমার ছেলেও ছিল। কয়েকজন জেলেও বলছে, তারা দুধসায়রে মাছ ধরার সময় একটা ঢ্যাঙা ভূতকে বাতাসা দ্বীপে দেখতে পায় মাঝে-মাঝে। ভয়ে আর কেউ দ্বীপটার কাছে যায় না। ভাবছি, কাল একবার সরেজমিনে হানা দিয়ে দেখে আসি।”
“যে আজ্ঞে। গেলেই হয়। তবে কিনা আপনাকে যেতে দেখলে ভূত কি আর বাতাসা দ্বীপে ঠ্যাঙ ছড়িয়ে বসে থাকবে বড়বাবু? তারও কি ভয়ডর নেই।”
“পালাবে বলছেন?”
মাথা নেড়ে রসময় বললেন, “ভূতপ্রেত বলে তো আর তাদের ঘাড়ে দুটো করে মাথা গজায়নি যে, আপনার সঙ্গে মোকাবেলা করতে যাবে।”
কথাটায় বাড়াবাড়ি থাকলেও মদন হাজরা খুশিই হলেন। বললেন, “তা হলে আর গিয়ে লাভ কী?”
“কিছু না, কিছু না।”
বাতাসা দ্বীপের ভূতের কথা রসময়ও জানেন। তিনি এও জানেন, মদন হাজরা গিয়ে হাল্লা মাচিয়ে যা করবেন তাতে ভূতের কিছুই হবে না। বরং সাবধান হয়ে যাবে।
মদন হাজরা বিদায় নেওয়ার পর রসময় বারান্দায় বসে গভীর চিন্তা করলেন। তাঁর মনের মধ্যে একটা কিছু যেন টিকটিক করছে। ঠিক করতে পারছেন না।
জগাপাগলাকে পিস্তল দেওয়া হল বাঘ মারার জন্য? নাকি মানুষ মারার জন্য? শূলটা চুরি করতে গেলে জগাপাগলাকে গুলি চালাতেই হত। তা হলে কে মারা পড়ত? হরুয়া। বোমাটা গগনবাবুর ঘরে রেখে আসতে বলা হয়েছিল। কে মারা পড়ত? গগনবাবু। তা হলে একটা লোক কি আড়ালে থেকে দু-দুটো লোককে খুন করাতে চায়? তবে নিজে করছে না কেন? বোমা পিস্তল যখন আছে, তখন নিজেই তো খুন করতে পারে, জগাকে কাজে লাগাতে চাইছে কেন?