রসময় বললেন, “তা সেটা আগে বলোনি কেন? হঠাৎ করে এসে পথ আটকালে তো হবে না! আমি জরুরি কাজে যাচ্ছি।”
“আজ্ঞে, এ কাজটাও কম জরুরি নয়। মালক্ষ্মী কূপিত হলে তো শুধু আমাদের ওপরেই হবেন না, পূজারীর ওপরেও হবেন। ঠাকুরমশাইয়ের কি সর্পভয়ও নেই নাকি?”
“ওঃ, জ্বালালে দেখছি!”
“আজ্ঞে, বেশিক্ষণ তো নয়। পাঁচটা মিনিট একটু অংবং বলে দুটো ফুল ফেলে চলে আসবেন।”
“ঠিক আছে বাপু, চলো। তা তোমার বাড়িটা কোথায়?”
“এই যে এদিকে।”
লণ্ঠনের আলোটা বড়ই কমজোরি। তাতে লোকটাকে ভাল দেখা যাচ্ছিল না। আগে-আগে হাঁটছে। পথ ছেড়ে একেবারে মাঠঘাট দিয়ে চলেছে।
“কই হে? কোথায়?” রসময় হাঁক মারলেন। “এই যে আর একটু।” হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ রসময় থমকে দাঁড়ালেন। “সর্বনাশ!”
৬. ফটিকবাবুর বারান্দাটা বেশ চওড়া
ফটিকবাবুর বারান্দাটা বেশ চওড়া। জগা তার চট আর ছেঁড়া চাঁদরখানা যত্ন করে পেতে বিছানা করে ফেলল। ঝোলাখানাকে বালিশ করে শুয়ে পড়লেই হল! আজ মহেশবাবুর মায়ের কী একটা পুজো ছিল। ভরপেট খিচুড়ি খাইয়েছে। পেট ঠাণ্ডা থাকলে ঘুমটাও বেশ ভাল হয়।
জগা একটা হাই তুলল, তারপর স্বপ্নের কলটা ঝোলা থেকে বের করে মাথার পাশে রেখে শুয়ে পড়ল। পরেশবাবু কলটা ভুলই দিয়েছেন। জিলিপির বদলে জিবেগজার কল। তা হোক, জিবেগজাও তার দিব্যি লাগে।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে যখন ঘুমটা বেশ ঘনিয়ে আসছে সেই সময়ে লোকটা এল। “এই যে জগা! কী খবর?”
জগা বিরক্ত হয়ে বলল, “ইস জিবেগজার স্বপ্নটা এইবারই শুরু হতে যাচ্ছিল, তা দিলেন তো বারোটা বাজিয়ে?”
লোকটা অবাক হয়ে বলল, “জিবেগজা! জিবেগজা হবে কেন? জিলিপি নয়?”
জগা এবার টপ করে উঠে বসে বলল, “আপনি কি পরেশবাবু?”
“হ্যাঁ, আমিই পরেশবাবু, তবে অনেকে নফরচন্দ্রও বলে।”
জগা খুশি হয়ে বলে, “আজ্ঞে, কলটা আপনি ভুলই দিয়েছেন বটে! এটা মোটেই জিলিপির কল নয়, জিবেগজার কল।”
“এঃ হেঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো তা হলে! দাও তা হলে ওটা বদলে দিই।”
“জিবেগজাও বেশ লাগছে কিন্তু!”
“আরে দূর! এবার তোমাকে রাজভোগের কল দিয়ে যাব। রাজভোগের কাছে কি আর জিবেগজা বা জিলিপি লাগে?”
“তা সত্যি! রাজুভোগ হলে তো কথাই নেই।”
“তা ইয়ে, সেই কলটা গগনবাবুর ঘরে রেখে আসতে পারোনি বুঝি!”
“আজ্ঞে কী করি বলুন! কুকুরে এমন তাড়া করল যে, পালিয়ে বাঁচি না, তা বাগানে ফেলে এসেছিলুম। তারপর কী যেন গণ্ডগোল হয়েছে।”
লোকটা ভালমানুষের মতো বলল, “তাতে কী? এবার এমন ব্যবস্থা করে দেব যে, আর কাজ ভণ্ডুল হওয়ার জো নেই। এই যে দেখছ আমার হাতে, এটা হল ভূতযন্ত্র।”
জগা অবাক হয়ে দেখল, লোকটার হাতে কালোমতো বিটকেল একটা যন্তর বটে!
জগা বলে, “আজ্ঞে দ্রব্যটা কী?”
“এর ভেতর থেকে ভূত বেরোয়।”
“ওরে বাপ রে!”
“ভয় পেয়ো না। যন্ত্র যার হাতে থাকে ভূত তার ক্ষতি করে।”
“বটে!”
“এই যন্তরটা নিয়ে রাত নিশুত হলে গগনবাবুর বাড়িতে যাবে। দক্ষিণের ঘরে গগনবাবু শোয়। জানো তো?”
“খুব জানি।”
পরেশবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন, “এবার আর স্বপ্ন নয়, গগনবাবুর ঘরে একেবারে জ্যান্ত ভূত ছেড়ে দিয়ে আসবে। এই যে দেখছ নল, এটা গগনবাবুর মাথার দিকে তাক করে এই যে ঘোড়াটা দেখছ এটা টিপে ধরবে। অমনই দেখবে একটা ঝলকানি দিয়ে আর শব্দ করে যন্ত্র থেকে ভূতের পর ভূত গিয়ে ঘরের মধ্যে কেমন নাচানাচি আর লাফালাফি করে। ব্যস, ওখানে কয়েকটা ভূত ছেড়ে দিয়েই পালিয়ে আসবে।”
জগা মাথা চুলকে বলল, “কুকুরটা যে তেড়ে আসে মশাই। আমি কুকুরকে বড্ড ভয় পাই।”
“সেই ব্যবস্থাও আছে। এই যে প্লাস্টিকের ব্যাগে একটুকরো মাংস দেখছ, কুকুরটা এলেই মাংসের টুকরোটা বের করে ছুঁড়ে দিয়ো। খেয়েই কুকুরটা নেতিয়ে পড়বে। তারপর আর ভয়টা কাকে? ভূতটা ছেড়ে দিয়েই চলে আসবে, পারবে না? সোজা কাজ। আর এই নাও কুড়িটা টাকা, কাল ভূপতির দোকানে গরম-গরম লুচি আর হালুয়া খেয়ো।”
জগা খুশি হয়ে টাকাটা ট্যাঁকে খুঁজে বলল, “খুবই সোজা-সোজা কাজ দিচ্ছেন। মাঝে-মাঝে শক্ত কাজও দেবেন।”
“এক আর বেশি কথা কী? তোমার মতো যোগ্য লোক আর আছেটাই বা কে! তা আজ রাতেই একটা শক্ত কাজ করবে নাকি? যদি করো তো আরও কুড়িটা টাকা আগাম দিয়ে যাই।”
“আজ্ঞে, কী যে বলেন! শক্ত কাজ না পারার কী আছে মশাই! সারাদিন আমি কত শক্ত-শক্ত কাজ করে বেড়াই। এই ধরুন, গাছে উঠে পড়লুম, ফের নেমে এলুম। তারপর ধরুন এই এত বড় একটা ঢিল তুলে ওই দূরে ছুঁড়ে দিলুম। তারপর ধরুন, দুধসায়র থেকে ঘটির পর ঘটি জল তুলে ফের দুধসায়রেই ঢেলে দিলুম।”
“বাঃ, এসব তো অতি কঠিন কাজ।”
“তা হলেই বলুন।”
“বলেই ফেলি তবে, কেমন? গগনবাবুর ঘরে ভূত ছেড়ে দিয়েই তুমি ভূত-যন্ত্রটা নিয়ে সোজা রাজবাড়িতে চলে যাবে।”
“তা গেলুম।”
“গিয়ে হরুয়া আর তার ভাই কেলোকে দেখতে পাবে। রাতে দু’জনেই থাকে। যন্ত্রটা তুলে ঘোড়া টিপে ধরে থাকবে, দেখবে গোল্লা-গোল্লা ভূত গিয়ে ওদের এমন তাড়া করবে যে, ভয়ে দুজনে মাটিতে কুমড়ো-গড়াগড়ি যাবে। সেই ফাঁকে হয়ার ট্যাঁক থেকে চাবিটা সরাতে তোমার একটুও কষ্ট হবে না। হবে নাকি?”
“আরে না, না, এ তো সোজা কাজ।”
“ব্যস, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। চাবিটা হাতে নিলেই আমি হাজির হয়ে যাব।”