রসময় লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, “চলো হে জগা, ঝোলাটা সাবধানে কাঁধে ঝুলিয়ে নাও। দেখো, পড়ে টড়ে না যায়। স্বপ্নের কলে চোট লাগা ভাল নয়।”
জগা ঝোলা নিয়ে উঠল। বলল, “চশমার কথাটা একটু খেয়াল রাখবেন ঠাকুরমশাই।”
“খুব রাখব। হ্যাঁ, ভাল কথা। আজও কি কুনকেঁদের বারান্দাতেই রাতে শোবে নাকি?”
ঘনঘন মাথা নেড়ে জগা বলল, “না মশাই, না। রোজ-রোজ এক বাড়িতে শুলে কি আমার চলে! আমার পাঁচজনকে দেখতে হয় যে। আজ ভাবছি ফটিকবাবুর বারান্দায় শোব।”
“বেশ, বেশ।” জগা খুশি হয়ে বলল, “ফটিকবাবুর বারান্দা বেশ জায়গা। উলটো দিকে ফলসা বনে নিশুত রাতে জ্যোৎস্না উঠলে পরিরা আসে। উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে বেড়ায়। তারা লোকও খুব ভাল।”
“তাই নাকি? ভাল, ভাল।”
বাঁশবনের ভেতরকার নির্জন কাঁচা রাস্তাটা পেরিয়ে জগা বাঁ দিকে ফটিকবাবুর বাড়ির মুখো রওনা হল। রসময় ডান দিকে ফিরে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন।
মদন দারোগা তাঁকে দেখে ভারী খুশি হয়ে বললেন, “আরে, আসুন, আসুন রসময়বাবু, ভাল কথা, কিছু মনে পড়ল নাকি? আপনার কাছে ভাল-ভাল কথা শুনব বলেই বসে আছি। তা বলুন তো মশাই, কয়েকটা মোক্ষম ভাল কথা।”
রসময় প্রথমে মাথা চুলকোলেন, তারপর হাত কচলে বললেন, “আজ্ঞে বড়বাবু, ভাল কথা কিছুই মনে আসছে না।”
“আহা, একটু বসুন, একটু ভাবুন, ঠিক মনে পড়ে যাবে।”
“যে আজ্ঞে। তবে কিনা বসার একটু অসুবিধে আছে।”
“কেন বলুন তো! ফোড়া-টোড়া হয়েছে নাকি? কিংবা হাঁটুতে বাত?”
ভারী বিনয়ের সঙ্গে রসময় বললেন, “আজ্ঞে, সে বরং ভাল ছিল। এ তার চেয়েও মারাত্মক। জগাপাগলা তার ঝোলার মধ্যে একখানা বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“সর্বনাশ! আবার বোমা! এই কি আপনার ভাল কথা? বোমা সে পেল কোথায়?”
“আজ্ঞে, পরেশবাবু বলে কে একজন মাঝরাতে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গছিয়ে গেছে।”
মদন হাজরা আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “সর্বনাশ? আবার এগারোজন পরেশবাবুকে ধরে আনতে হবে নাকি! এ তো বড় ঝামেলাই হল দেখছি! জানেন মশাই, এগারোজন বামাচরণ আমার নামে মানহানির মামলা করবে বলে উঁকিলের চিঠি দিয়েছে। শুধু কি তাই? সবুজ চেক লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা সাতটা লোক রোজ এসে ক্ষতিপূরণের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে।”
“খুবই দুঃখের কথা বড়বাবু, আপনাদের জীবনটাই তো এরকম। পরের জন্য এত করেন, তবু কেউ গুণের কথা বলে না। কেবল দোষ খুঁজে বের করে।”
“বাঃ! এই তো একটা ভাল কথা বললেন! বাঃ বাঃ! এ তো চমৎকার কথা! শুনে মনটা ভাল হয়ে গেল মশাই। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন!”
“আজ্ঞে, জগাপাগলার ঝোলার মধ্যে একখানা মিলিটারি বোমা ফাটো-ফাটো করছে। এই ফাটে কি সেই ফাটে অবস্থা।”
মদন হাজরা লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “কোথায় জগা? অ্যাাঁ! কোথায় সে? ওরে গুলবাগ সিং, সেপাই-টেপাই নিয়ে যা তো বাবা, ব্যাটাকে একেবারে হাতকড়া দিয়ে ধরে আন।”
রসময় হাত কচলে বললেন, “আজ্ঞে বড়বাবু, জগাকে ধরে আনলে তেমন কাজ হবে না। বরং কাজটা কেঁচে যাবে।”
মদন হাজরা ধপ করে বসে পড়ে বললেন, “আপনি বোধ হয় আরও একটা ভাল কথা বলতে চাইছেন! তা হলে বলেই ফেলুন।”
“আজ্ঞে, ভাল কিনা জানি না। আমাদের মাথায় যা আসে বলে ফেলি। তা ভাল না মন্দ সেটা আপনার মতো দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বিচার করবেন।”
মদন হাজরা খুশি হয়ে বললেন, “বাঃ এটাও ভাল কথা। এবার বলুন।”
“বলছিলাম কি, ধরপাকড় না করে বরং জগার ওপর নজর রাখলে ওই পরেশবাবু বা বামাচরণ যে-ই হোক, তাকে ধরে ফেলা যাবে। জগা নির্দোষ, বোমা বন্দুক সে চেনে না। তাকে পাগল পেয়ে কেউ আড়াল থেকে এসব করাচ্ছে।”
মদন হাজরা ভাবিত হয়ে বললেন, “হুম, তা লোকটা কে?”
“হয় বামাচরণ, নয় তো পরেশবাবু।” গগনবাবুর বাড়ির বোমাটা যে জগাপাগলাই রেখে এসেছিল তা আর রসময় ভাঙলেন না। তা হলে জগার কপালে দুঃখ ছিল।
মদন হাজরা দুলে-দুলে কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “খুবই চিন্তার কথা। কিন্তু বোমাটা যে ওর কাছে রয়েছে, সেটা যে সরানো দরকার। গ্রেফতার না করলে–”।
রসময় ঘাড় চুলকে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আজ্ঞে, জগা আজ ফটিকবাবুর বারান্দায় শুয়েছে। আমাকে যদি দশ মিনিট সময় দেন তা হলে আমি গিয়ে বোমাটা সরিয়ে ফেলব। অবশ্য যদি আপনার মত থাকে।”
মদন হাজরা একগাল হেসে বললেন, “খুব মত আছে। খুব মত আছে। বোমাটোমা থানায় রাখা বড্ড ঝকমারি মশাই। আপনি বরং বেরিয়ে পড়ুন। আমরা আধঘণ্টা বাদে যাচ্ছি।”
“যে আজ্ঞে,” বলে রসময় বেরিয়ে পড়লেন।
বেশ জোর কদমেই হেঁটে যাচ্ছিলেন রসময়। ফটিকবাবুর বাড়ির কিছু আগে হাপু ডাইনির মোড়। জায়গাটা খুব নির্জন। চারদিকে ঝোঁপঝাড়।
হঠাৎ কে যেন অন্ধকার থেকে বলে উঠল, “ঠাকুরমশাই নাকি?”
রসময় বললেন, “হ্যাঁ।”
“একটু উপকার করতে হবে যে ঠাকুরমশাই। আমার বাড়িতে
নাকি?
আজ লক্ষ্মীপুজো, দুটো ফুল-পাতা ফেলে দিয়ে যেতে হবে যে!”
“পাগল নাকি? আমি আজ বড় ব্যস্ত। জীবন-মরণ সংশয় হে বাপু, ওই পাঁচালি-টাঁচালি পড়ে চালিয়ে নাওগে যাও। আমার আজ সময় হবে না।”
লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। লণ্ঠনের আওতার বাইরে একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়ানো। বলল, “তাই কি হয়? আমার বউ যে সকাল থেকে নির্জলা উপোস করে বসে আছে। পুজো না হলে জলটুকুও খাবে না।”