“পাঁচ কান করব কেন? বলে ফেল।”
“আজ্ঞে, আমি তো কুনকেঁদের কাছারিঘরের বারান্দায় শুই, তা সেখানেই দেখা।”
“ঘটনাটা খোলসা করে বলো।”
“পরশু রাতে শুয়ে আছি মুড়িসুড়ি দিয়ে। একটা ভারী ভাল স্বপ্নও দেখছিলুম। এক রাজবাড়িতে ভোজ হচ্ছে। আর আমার পাতে একজন লোক গরম-গরম জিলিপির পর জিলিপি দিয়ে যাচ্ছে। দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে। দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। ওঃ সে একেবারে জিলিপির পাহাড় হয়ে গেল।”
“তারপর?”
“ওই সময়েই পরেশবাবু এসে ঠেলে তুললেন, “ও জগা, ওঠো ওঠো! তা উঠে ভারী রাগ হল। বললুম, মশাই, দিলেন তো জিলিপির স্বপ্নটার বারোটা বাজিয়ে! তিন-চারটে খেয়েছি কি
-খেয়েছি অমনই কাঁচা ঘুমটা ভাঙালেন! কত জিলিপি বাকি রয়ে গেল বলুন তো!’ তখন পরেশবাবু খুব হাসলেন। বললেন, “স্বপ্ন দেখতে চাও, তার আর ভাবনা কী? তোমাকে এমন একটা কল দিচ্ছি যা থেকে কেবল রোজ জিলিপির স্বপ্নই বেরিয়ে আসবে। রোজ সারারাত ধরে কত খাবে খাও।”
“বটে।”
“তবে আর বলছি কী! কলটা শুধু মাথার কাছে রেখে শুলেই হবে।”
“তারপর?”
“তা পরেশবাবু একটা নয়, দু-দুটো কল আমার হাতে দিয়ে বললেন, “শোনো জগা, এই বাঁ হাতেরটা তোমার। এটাতে শুধু জিলিপির স্বপ্ন ভরা আছে।”
জগা একটু থামতেই রসময় বলে উঠলেন, “আর একটা?”
জগা মাথা চুলকে বলল, “আপনাকে বলেই বলছি। পাঁচ কান করবেন না। আর-একটা কলে ভূতের স্বপ্ন পোরা ছিল। পরেশবাবু বললেন, ‘জানো তেতা, দু’পাতা সায়েন্স পড়ে নাস্তিকরা আর ভূতপ্রেত মানে না। ওই গগনবাবু আর তার ছেলে গোবিন্দ ভারী নাস্তিক। এই তো সেদিন বাতাসা দ্বীপের ঢ্যাঙা ভূতের কথা বলতে গিয়েছিলাম, তা এমন হাসিঠাট্টা করল যে, বলার নয়। তাই ওদের একটু শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই কলটা বানিয়েছি। চুপিচুপি গিয়ে গগনবাবুর ঘরে রেখে আসলেই হবে। রাখার আগে কলের গায়ে একটা জিনিস কামড়ে ছিঁড়ে দিতে হবে। দেখবে প্রতি রাতে বিটকেল সব ভূতের স্বপ্ন দেখে বাপ-ব্যাটা কেমন চেঁচামেচি লাগায়।”
“তারপর?”
“তা আজ্ঞে, গগনবাবুর ওপর আমারও একটু রাগ আছে। মেয়ের বিয়েতে ভোজ খেতে গিয়েছিলুম। তিনবার লাইন থেকে তুলে দিল, বলল, পরের ব্যাচে বসিস। তা শেষে বসলুম বটে, কিন্তু ঘ্যাঁটম্যাট ছাড়া কিছুই জুটল না। শেষ পাতে লালমোহনটা অবধি দিলেন না। কী অবিচার বলুন তো!”
“তা অবশ্য ঠিক।”
“তাই আমি পরেশবাবুর কথামতো কলটা রেখে আসতে গিয়েছিলুম। কিন্তু ওদের কুকুরটা এমন তাড়া করল যে, ভয়ে বাগানে ফেলে আসি।”
“অ। তা তোমার কলটা কই?”
“কেন, এই যে আমার ঝোলার মধ্যে!” বলতে বলতে জগা তার ঝোলায় হাত পুরে কালো আনারসটা বের করে এনে রসময়কে দেখিয়ে একগাল হেসে বলল, “রোজ শিয়রে নিয়ে শুই। কাল রাতেও খুব জিবেগজা খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি মশাই। মনে হয় পরেশবাবু ভুল করে একটা জিবেগজার কলই দিয়ে গেছেন। তা জিবেগজাই বা খারাপ কী বলুন!”
জিনিসটা দেখে রসময়ের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! তবে তিনি মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে বললেন, “ঠিক আছে, ওটা ঝোলায় রেখে দাও সাবধানে। বেশি নাড়াচাড়া করা ভাল নয়। ওতে জিবেগজার খুব ক্ষতি হয়।”
জগা সাবধানেই জিনিসটা পুরে রাখার পর রসময় বললেন, “এবার বলো তো, পরেশবাবুটা কে?”
জগা জুলজুল করে চেয়ে বলে, “আজ্ঞে পরেশবাবু খুব ভাল লোক। আমাকে জিলিপি খেতে পাঁচটা টাকাও দিয়েছেন। বলেছেন, স্বপ্নের জিলিপি খাওয়া ভাল, আবার জেগে খাওয়াও ভাল।”
“সে তো বুঝলুম। কিন্তু লোকটা থাকে কোথায়?” মাথা নেড়ে জগা বলে, “তা জানি না।”
“দেখতে কেমন?”
“আজ্ঞে, বেঁটেমতো। মাথায় টাক আছে।”
“ঠিক তো! পরে আবার গুলিয়ে ফেলো না। বামাচরণকে নিয়ে যা করলে সেটা তো যাচ্ছেতাই ব্যাপার।”
“আজ্ঞে না, এবার আর গণ্ডগোেল পাবেন না। বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। এই আপনার মতোই নাটা মানুষ!”
রসময় ভারী অবাক হয়ে বলে, “আমি আবার নাটা হলাম কবে থেকে? সবাই তো বলে আমি একজন লম্বা মানুষ।”
“অ্যাাঁ, আপনি বেঁটে নন?”
“কস্মিনকালেও না।”
ঘ্যাঁস-ঘ্যাঁস করে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে জগা বলল, “তা হলে তো বড্ড মুশকিলে ফেললেন ঠাকুরমশাই। আমি যে আপনাকে বেঁটে বলেই জানতুম। আপনি বেঁটে, মহেশবাবু বেঁটে, ফটিকবাবু বেঁটে, খাসনবিশ বেঁটে।”
রসময় বললেন, “তুমি যে মুড়ি-মিছরির এক দর করে ফেললে হে! ফটিকবাবু বেঁটে হলেও মহেশবাবু বেশ লম্বা। আর খাসনবিশ মাঝারি।”
জগা জুলজুল করে চেয়ে বলল, “বড্ড ভাবনায় ফেললেন ঠাকুরমশাই। এখনও খিচুড়ির ব্যাপারটাই মেটেনি, মাথায় আবার নতুন একটা ভাবনা ঢুকল।”
“ভাল করে ভেবে বলো তো, পরেশবাবু বেঁটে, না লম্বা।”
জগা খুব লজ্জিত মুখে বলে, “লম্বাই হবেন বোধ হয়।”
“গোঁফ আছে?”
“থাকার কথা নাকি ঠাকুরমশাই? তা হলে আছে।”
“নাঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না দেখছি।”
“এইজন্যই তো আমি একটা চশমা চাইছি। চশমা চোখে দিলে বাহারও হয়, আর লম্বা না বেঁটে, কালো না ধলো তাও ঠাহর হয়। কিন্তু কেউ চশমা দিচ্ছে না মশাই। ফটিকবাবুকে বললুম, “আপনার মা তো গত হয়েছেন, তাঁর চশমাজোড়া আমাকে দিন।’ তা তিনি খ্যাঁচ করে উঠলেন, “সোনার চশমা তোমাকে দিই আর কি! মহেশবাবুকেও বলেছিলুম, আপনার তো দুজোড়া চশমা, দিলেনই না হয় আমাকে একজোড়া।’ তা ভ্যাল ভ্যাল করে চেয়ে থাকেন, কথা কানেই তোলেন না। এরকম হলে তো আমার চলে না মশাই। চশমা ছাড়া বড়ই অসুবিধে হচ্ছে।”