“আরে, ওসব পুরনো কথা আবার কেন? কাজের কথাটাই হোক ! কার উপর নজর রাখতে হবে?”
“আজ্ঞে, লোকটার নাম খাঁদু গড়াই।”
“ওরে বাবা! শুনেই বুকটা কেমন করছে! তা ছাড়া উঁকিঝুঁকি মারা খুব খারাপ। উঁকিঝুঁকি মারলে আমার বড় গা শিরশির করে।”
দ্বিজপদ খুব চিন্তিত মুখে ছাদের দিকে চেয়ে গলা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “তাই তো কাশীদা, বড় মুশকিলে ফেলে দিলেন। ভাবছি, বিজয়বাবুকে এখন কী বলি! সম্বন্ধটা যখন আমিই করেছি, তখন আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে। তিনি বড় আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন যে!”
কাশীবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, “আহা, বিজয়বাবুকে আবার এর মধ্যে টানা কেন?”
“তিনি সাতবেড়ের শিকারি বিশ্বজয় রায়ের নাতি। বাবা ভুবনজয়ও ছিলেন পক-প্রণালী জয়ী বিখ্যাত সাঁতারু, কামট, কুমির, হাঙরকেও ডরাতেন না। আপনি যে এত ভিতু, সেটা পাঁচকান হলে বিজয়বাবু তাঁর মেয়ে বঁচির সঙ্গে আপনার বিয়ে দেওয়ার কথা আর কখনও উচ্চারণ করবেন কি? তাঁর তো ধারণা শশীরামের নাতি, নসিরামের ছেলে কাশীরামও বাপ-দাদার মতোই ডাকাবুকো লোক।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, না হয় খাঁদু গড়াইয়ের উপর নজর রাখব’খন। ও আর এমন কী শক্ত কাজ?”
“কাজ খুবই সোজা। খাঁদু কখন খায়, কখন ঘুমোয়, বাঁ ধারে কাত হয়ে ঘুমোয়, না ডান ধারে, হাঁ করে ঘুমোয় কিনা, নাক ডাকে কিনা, এই সব আর কী! তারপর ধরুন, দুপুরে বা নিশুতরাতে কোনও সন্দেহজনক লোক তার কাছে যাতায়াত করে কিনা বা সে কাউকে কোনও ইশারা ইঙ্গিত করে কিনা। কিংবা তার ঝোলায় কোনও অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা। পারবেন না?”
কাশীবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “তা পারা যাবে বোধহয়।”
“খুব পারা যাবে, খুব পারা যাবে। তারপর শুধু নজর রাখাই নয়, মাঝে মাঝে তার কাছে গিয়ে একটু খেজুরে আলাপও জুড়ে দেবেন। এই জিজ্ঞেস করলেন, বাপু হে, তুমি কি মিষ্টি পছন্দ করো, না ঝাল? লাল রং ভালবাসো, নাকি বেগুনি? ঠান্ডা ভাল না গরম? এরকম আগড়মবাগড়ম যা খুশি বলে গেলেই হল, দেখবেন কথার ফাঁকে হয়তো টক করে আসল কথাটা বেরিয়ে আসবে।”
কাশীবাবুর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটে নিয়ে বললেন, “সে তো বুঝলুম, কিন্তু আসল কথাটা কী?”
“সে কি আমিই জানি। এ হল ছিপ ফেলে বসে থাকার মতো ব্যাপার, মাছ উঠবে কিনা তার ঠিক নেই।”
“বুঝেছি। কী কুক্ষণে যে খাঁদু গড়াই এসে জুটল কে জানে!”
“ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন কাশীদা।”
কাশীবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, “এর মধ্যে মঙ্গলটা কী দেখলে শুনি! খাঁদু গড়াই হল ডাকাতের ভাইপো, তার উপর তান্ত্রিক পিশাচসিদ্ধ মানুষ। ওরকম বিপজ্জনক লোকের উপর নজর রাখা মানে তো সিংহের খাঁচায় ঢুকে পড়া, প্রাণ হাতে করে কাজ, এর মধ্যে মঙ্গলটা আসে কোত্থেকে?”
“নগদানগদি সব বোঝা যাবে না দাদা, ধৈর্য ধরতে হবে।”
“আর ধৈর্য! বাবামশাইকেও বলিহারি, যাকে-তাকে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন। এই তো গত বছর এক সাধুকে ধরে এনেছিলেন তার কাছে আকাশে ওড়া শিখবেন বলে। শেষ পর্যন্ত সেই সাধু মায়ের একছড়া হার, দাদুর পকেটঘড়ি, তিনটে কাঁসার থালা, আমার গরদের পাঞ্জাবি আর নরহরির নতুন গামছাখানা নিয়ে পিঠটান দিল। তবু কি তাঁর শিক্ষা হয়? এবার কী হবে কে জানে!”
৪. গুঁফো গনশা বলিয়ে কইয়ে মানুষ
গুঁফো গনশা বলিয়ে কইয়ে মানুষ। বক্তৃতার শেষ দিকটায় সে আক্ষেপ করে বলল, “ভাল কোচিংয়ের অভাবেই আমরা এইসব অনুপ্রবেশকারী লুঠেরাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছি না। আমাদের প্রতিভা কিছু কম নেই, সাহস বা সংযমেরও অভাব নেই। ভাল ফরেন কোচ পেলে আমরা এলাকায় এখনও আধিপত্য করতে পারি। হ্যাঁ, আর দরকার হল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, আর ভাল নেটওয়ার্ক।”
মারকুটে মহেশ ঝাঁকি মেরে উঠে দাড়িয়ে বলল, “ফরেন কোচের কোনও দরকার নেই, আমার গুরু জটাবাবা কি খারাপ কোচ ছিল ? এমন মুষ্টিযোগ, এত প্যাচপয়জার জানত যে, লোকে নামই দিয়েছিল ‘জাদুকর জটাই’, ভারতীয় যোগবিদ্যাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ।”
এই কথায় চাকু চপল আপত্তি করে বলল, “ওসব পুরনো যোগবিদ্যা এযুগে চলে না মশাই। এ হল কম্পিউটার, লেজার, স্ট্রেসারের যুগ, এ কে ফর্টি সেভেনের সামনে তো আর প্রাণায়াম দিয়ে লড়া যায় না। গোবিন্দদা ঠিকই বলেছে, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না হলে ওই রাখালহরির কাছে মুচলেকা দিয়ে এই এলাকায় বসবাস করতে হবে। যাকে বলে সেকেন্ড গ্রেড সিটিজেন।”
হাড়ভাঙা হারাধনের ডেরায় কাল রাতেই হানা দিয়ে রাখালহরি, তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, বুকে এ কে ফর্টি সেভেনের নল ঠেকিয়ে কান ধরে ওঠবস করিয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থায় এখনও তার চোখ ছলছল করছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলল, “আমি যদিও সনাতন পন্থাতেই বিশ্বাস করি, এবং জানি, আমাদের শিক্ষক ও ওস্তাদরা নানা গুপ্তবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, তবু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, রাখালহরির বিদেশের ট্রেনিং থাকায় তার সঙ্গে আমি পেরে উঠিনি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, প্রথম জীবনে কুঠিবাড়ি লুট করে সে চিনে চলে গিয়েছিল। সেখানে কয়েক বছর চিনা কোচের কাছে প্রশিক্ষণ পায়। এই যে কাল রাতে সে আমার ছাউনিতে চড়াও হল, তার মোডাস অপারেন্ডি আমরা ধরতেই পারলাম না। ছাউনির চারদিকে শক্ত পাহারা ছিল, তবু সে কী করে যে ব্লিৎস ক্রিগ করে অত লোককে বোকা বানিয়ে অস্ত্র কেড়ে নিল, তা এখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। একথা ঠিক যে, আমি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছেই পরাজিত হয়েছি, কিন্তু ভাববার বিষয় হল, আমাদের মান উন্নত না করলেও আর চলছে না।”