“এতেই ঘাবড়ে গেলেন কাশীদা! এখনও তো আপনাকে আসল কথাটা বলাই হয়নি।”
কাশীবাবু কাহিল মুখে বললেন, “এর পর আর কী কথা থাকতে পারে বলো তো! কানাইদারোগারই যদি এত হেনস্থা হয়, তবে আমরা তো কোন ছার! আকাশে ভগবান আর মর্ত্যধামে দারোগা পুলিশ ছাড়া আমাদের আর ভরসা কী বলো!”
“সে তো বটেই। তবু বাকিটা শুনলে কলির শেষে কী ঘটতে চলেছে তার একটা আঁচ পাবেন। রাখালহরি গড়াই সম্পর্কে আপনার কিছু জানা আছে কি?”
“না হে বাপু। শুধু শুনেছি, সে খাঁদুর খুড়ো।”
দ্বিজপদ মুচকি হেসে বলে, “তবু সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। সে হল ডাকাতেরও ডাকাত। সাধারণ ডাকাতরা গেরস্তর বাড়িতে চড়াও হয়ে লুঠপাট করে। রাখালহরি তা তো করেই, উপরন্তু সে ডাকাতদের উপরেও চড়াও হয়ে তাদের সর্বস্ব লুটেপুটে নিয়ে যায়। আগে যে-এলাকায় সে ছিল, সেখানে তার অত্যাচারে তিনজন ডাকাত সর্বস্বান্ত হয়েছে, দু’জন বিবাগী হয়ে গিয়েছে, একজন গলায় দড়ি দিতে গিয়ে স্যাঙাতদের হস্তক্ষেপে বেঁচে যায়, একজন পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দু’জন গিয়ে জেলখানায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচেছে।”
কাশীবাবু হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “আর তারই ভাইপো কিনা আমাদের বাড়িতে বসে ডাল-রুটি সাঁটাচ্ছে! লোকটাকে যে এক্ষুনি পুলিশে দেওয়া দরকার!”
“ব্যস্ত হবেন না কাশীদা। রাখালহরির ভাইপো শুনলে পুলিশ তার ধারেকাছে যেতেও সাহস পাবে না। আর তার কিছু হলে রাখালহরিই কি আপনাকে আস্ত রাখবে? রাখালহরির ওয়ারিশন বলতে শুধু ওই ভাইপোটাই আছে। বংশে বাতি দিতে ওই একমাত্র শিবরাত্রির সলতে। রাখালহরির বয়স হয়েছে। লাখো লাখো টাকার একজন উত্তরাধিকারী চাই। তা ছাড়া সে বুড়ো হলে তার দলের হাল ধরার জন্যও উপযুক্ত লোক চাই। তাই রাখালহরি এখন হন্যে হয়ে তার ভাইপোকে খুঁজছে।”
“ওরে বাবা! তারা তো তা হলে এল বলে!”
“ঘাবড়াবেন না। রাখালহরি যত ভয়ংকরই হোক, এই পরগনার ডাকাতরাও তাকে ছেড়ে কথা কইবার পাত্র নয়। তাদের তো
প্রেস্টিজ বলেও একটা ব্যাপার আছে। জল্লাদ-প্রহ্লাদ, গুঁফো গণেশ, হাড়ভাঙা হারাধন, লেঠেল ললিত বা সড়কি সতীশ, এরা কি কিছু কম যায়? রাখালহরিকে ঢিট করার জন্য তারা এখন সব এককাট্টা হচ্ছে। ঘনঘন গোপন বৈঠকে বসছে। রাখালহরির ওয়ারিশকে তারাও খুঁজছে।”
“দ্বিজপদ, তোমাকে একটা কথা কইব?”
“কী কথা কাশীদা?”
“তুমি কি জানো যে, ঝড়ে জানালার ভাঙা কপাট যেমন আছাড়ি পিছাড়ি করে, আমার বুকের ভিতরটায় এখন তেমনই হচ্ছে! আমাকে আর বেশি ভয় দেখানোটা কি তোমার উচিত? এখন হার্ট ফেল হয়ে গেলে এতটা পথ হেঁটে বাড়ি যাব কী করে? এখনও নাওয়াখাওয়া বাকি?”
“হার্ট ফেল হওয়া কি সোজা ? আপনার হল বীরের বংশ, ঠাকুরদা শশীরাম হরিরামপুরের ডাকসাইটে দারোগা ছিলেন, বাবা নসিরাম ছিলেন লড়াকু মিলিটারি।”
কাশীবাবু চিন্তিত মুখে বললেন, “সেটাও বুঝি রে ভাই! আমার ভিতরেও যে বীর হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তা নয়। ইচ্ছেও যায়, তবে কী জানো, ওই ভয় ব্যাটাকে নিয়েই মুশকিল, যখনই বীরের মতো কিছু করতে যাই, তখনই ওই ব্যাটা ভয় এসে এমন বাগড়া দেয় যে, কাজটা ফসকে যায়। এই কদিন আগে মাঝরাতে চোর এসেছিল, জানালায় খুটখাট শব্দ শুনে ঘুম ভাঙতেই ‘চোর চোর’ বলে চেঁচাতে গিয়েছি, অমনি পাশ থেকে ভয় ব্যাটা মুখ চেপে ধরে ধমক দিয়ে বলল, চুপ, চুপ, খবরদার চেঁচাসনি! চোরের কাছে অস্তর থাকে জানিস না?’এই তো গত হাটবারে সকালবেলায় মহিমবাবুকে ষাঁড়ে তাড়া করেছিল। ভাবলাম, যাই, ষাঁড়টাকে লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে বুড়ো মানুষটাকে রক্ষে করি। হাতে লাঠিও ছিল। কিন্তু যেই তেড়ে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, অমনি পিছন থেকে ওই ব্যাটা ভয় একেবারে কোমর জাপটে ধরে বলল, ‘পাগল নাকি? ওই খ্যাপা ষাঁড়ের মুখখামুখি হতে আছে রে আহাম্মক? মানুষ তো অদৃষ্ট নিয়েই জন্মায়। মহিমবাবুরও অদৃষ্টে যা আছে তাই হবে, তুই বাগড়া দেওয়ার কে?’ তোমার কাছে কি ভয় তাড়ানোর কোনও ওষুধ আছে হে দ্বিজপদ?”
দ্বিজপদ বলে, “আহা, ভয়কে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আছে থাক না, তবে ভয়েরও মাঝে মাঝে ঝিমুনি আসবে, কিংবা ধরুন, মানুষের মতো তারও হয়তো ছোট বাইরে বা বড়-বাইরে পাবে, কিংবা ধরুন, পায়ের ঝিঝি কাটাতে ভয় হয়তো বারান্দায় পায়চারি করতে গেল, সেই ফাঁকে কাজ হাসিল করে নিলেই হয়।”
“কাজ হাসিল! কীসের কাজ হাসিল হে?”
“শক্ত কাজ করলে যে আপনার অম্বল হয়, একথা কে না জানে! কাজটা শক্ত তো নয়ই, বরং কাজ বললেও বাড়াবাড়ি হয়। কাজ না বলে বরং বলা ভাল, এই একজনকে একটু চোখে-চোখে রাখা আর কী।”
“আহা, সে আর শক্ত কী? নড়াচড়া বেশি না করতে হলেই হল, হুডযুদ্ধ যে আমার সয় না, এ তো তুমি ভালই জানো!”
“তা আর জানি না! আপনার হল আদরের শরীর, সেবার আপনার দাদু শশীরামের হাম হওয়ায় তিনি হাটে যেতে পারেননি, তাই হাটবারে আপনাকে মোট আড়াই কেজি আলু বয়ে আনতে হয়েছিল বলে আপনি এক হপ্তা শয্যাশায়ী ছিলেন, সে কথা কি ভোলা যায়? তারপর সেই যে আপনার বাবামশাই নসিরাম একখানা ছোট তোশক ছাদে নিয়ে রোদে দিতে বলায় আপনার কম্প দিয়ে জ্বর এসেছিল, সেকথা কি বিস্মরণ হওয়ার? তারপর ধরুন, গত বছর যে আপনি গোরুর গাড়ির ধর্মঘটের দরুন দেড় মাইল হেঁটে মাসির বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হাঁটুর ব্যথায় কাতর হয়ে দেড় ডজন রসগোল্লা খেয়েই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন, সে কথা বলে যে মাসি আজও হা-হুতাশ করেন, একথা কে না জানে বলুন! আপনাকে শক্ত কাজ দিলে ভগবান কি আমাকে ছেড়ে কথা কইবেন?”