বিশ্বেশ্বর অবাক হয়ে বলে, “নাকি? তা তোমার খুড়োর নাম কী হে?”
খাঁদু বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে, রাখালহরি গড়াই।” বিশ্বেশ্বর একটু ভেবে মাথা নেড়ে বলল, “না, এ-পরগনার নয়।”
নসিবাবু একটু তোয়াজ করে বললেন, “একটু নেড়েচেড়ে দ্যাখ না বাবা। ডলাইমলাই করলেই দেখবি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। আমার তো দেখেই মনে হয়েছিল, এর ভিতরে ডাকাতির জীবাণু একেবারে বিজবিজ করছে।”
“আপনি যখন বলছেন কর্তা, তখন দেখাই যাক। ওহে বাপু, একটু উঠে দাড়াও তো!”
খাঁদু উঠবার আগেই দুই পালোয়ান দু’দিক থেকে এসে তার নড়া ধরে হ্যাঁচকা টানে খাড়া করে দিল। বটু বলল, “প্রথমটায় একটু হাল্কা কাজই দিচ্ছি। দুশো বৈঠক মারো তো বাপু!”
খাঁদুর চোখ কপালে উঠল, “দুশো! বলেন কী মশাই! ইসকুলে অবধি দশবারের বেশি ওঠবস করায় না! এই ভরা পেটে বেশি নড়াচড়া করলে বদহজম হবে যে! অম্বল হয়ে যাবে।”
বিশু নসিবাবুর দিকে চেয়ে বলে, “শুনলেন, কর্তা? ডাকাতের অম্বল হয় কখনও শুনেছেন?”
নসিবাবু হেঁকে বললেন, “ওরে, ঠিকই বৈঠক মারবে। একটু কোঁতকা-টোঁতকা দিয়ে দ্যাখ না? আড় ভাঙতেই যা সময় লাগে।”
বিশু পট করে খাঁদুর বাঁ পাঁজরে দু’আঙুলে একটা খোঁচা মারতেই খাঁদু বাপ রে’ বলে লাফিয়ে উঠল।
বিশু মাথা নেড়ে বলল, “এ, এ যে একেবারে ভুসিমাল গছিয়ে গিয়েছে আপনাকে কর্তা! পাঁজরার হাড় তো প্যাকাটির মতো মুড়মুড় করছে।”
বটুও খুব চিন্তিত মুখে বলল, “দাবনায় তো মাংসই নেই কর্তা!”
নসিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “শোন বাপু, একটা গাট্টাগোট্টা চেহারার লোক পেলে তাকে তৈরি করা তো সোজা কাজ। তাতে কি মজা আছে কিছু? এই তালপাতার সেপাইকে যদি পালোয়ান না বানাতে পারলি তবে কীসের মুরোদ তোদের?”
বিশু লজ্জিত মুখে বলল, “তা কর্তা যখন বলছেন, মেহনত করলে অচল পয়সাও যখন চালানো যায়, তখন আমরাও চেষ্টা করে দেখব। আপনার একটু খরচাপাতি যাবে, এই যা!”
বটু খাঁদুর দিকে চেয়ে বলল, “কী হে বাপু, বৈঠক মারবে, নাকি ফের খোঁচাখুঁচি করতে হবে।”
খাদু পিটপিট করে দু’জনের দিকেই ভয়ে ভয়ে চাইল। তারপর বলল, “যে খোঁচা মেরেছেন মশাই, তাতেই তো শরীর ঝনঝন করছে। বৈঠক যে মারব, হাঁটুতে যে জোর পাচ্ছি না মোটে। তা জোরাজুরি যখন করছেন তখন অগত্যা মারতেই হয়।”
বলে খাদু টপাটপ বৈঠক মারতে শুরু করল। নসিবাবু কড় গুণে হিসেব রাখতে রাখতে মাঝে মাঝে তারিফ করে উঠতে লাগলেন, “বাহবা !… বহোত আচ্ছা!… চালিয়ে যা বাবা!… বাঃ বাঃ, এই তো দিব্যি হচ্ছে।”
তা হলও। বটু আর বিশুও হাঁ করে দেখল, খাদু গড়াই দিব্যি দুশোটা বৈঠক মেরে একটু হাঁদাতে হাদাতে বলল, “হল তো মশাই! এবার খ্যামা দিন।”
দুশো বৈঠক মারা যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা বটু আর বিশু ভালই জানে। ছোঁড়া যে অত বৈঠক একবারে মেরে দেবে, তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।
বিস্ময়টা চেপে রেখে বটু বলল, “মন্দ নয়। তবে এ তো অল্পের উপর দিয়ে গেল। এবার তোমার পাঞ্জার জোরটা যে একটু দেখাতে হচ্ছে বাপ। এই যে আমার ডান হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে দিলুম, তুমিও তোমার পাঁচ আঙুল দিয়ে কষে ধরো। যে যার ডান দিকে মোচড় দিতে হবে। বুঝলে?”
নসিবাবু বিশুকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, “ওরে, তুই একটু হিসেব করে মোচড় দিস। তোর তো হাত নয়, বাঘের থাবা, বেচারার কবজিটা আবার মট করে ভেঙে দিস না বাবা!”
“না, কর্তা! হিসেব করেই দিচ্ছি।”
কিন্তু বিশুর হিসেব একটু উলটে গেল। কারণ, খাদু গড়াইয়ের রোগাপানা হাতখানাকে যত দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর কথা, ততটা দেখায়নি বিশু। সে বেশ বাঘা হাতে চেপে ধরে পেল্লায় একটা মোচড় মেরেছে। কিন্তু এ কী! খাদু গড়াইয়ের দুবলা হাতখানা মমাটেই পাক খেয়ে গেল না। বরং তার সরু আঙুলগুলো লোহার আাঁকশির মতো বেশ বাগিয়ে ধরে আছে বিশুর মোটা মোটা আঙুল। কবজি টসকাল না, বরং যেন একটু একটু করে ডান দিকে ঘুরে যেতে লাগল। মিনিটখানেক একভাবে থাকার পর আচমকাই একটা রাম মোচড়ে বিশুর হাতখানা উলটে দিল খাঁদু। বিশু বাপ রে’ বলে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে অ্যাই বড় বড় চোখ করে খাঁদুর দিকে চেয়ে রইল।
নসিবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “শাবাশ!” কিন্তু ব্যাপারটা বিশ্বাস্যই নয়। বটু বা বিশু কেউ বিশ্বাস করতেই পারছিল না যে, এই রোগাপটকা লোকটা বিশুকে গোহারান হারিয়ে দিয়েছে।
নসিবাবু বললেন, “বলি ব্যাপারটা কী হল বল তো? ইচ্ছে করে হেরে গেলি নাকি?”
বিশু গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না, কর্তা, এর মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার ?”
“এ-লোকটা মন্তরতন্তর জানে। বোধহয় পিশাচসিদ্ধ।”
নসিবাবু হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন, “দুর, দুর! মন্তরতন্তর সব কুসংস্কার। মন্তরে কাজ হলে আর লোকে এত কসরত করত না। বোমাবন্দুকও রাখত না। ওসব নয় রে। এই খাঁদু গড়াইয়ের ভিতরে খাঁদু ডাকাত ফুসছে। ও আমি দেখেই চিনেছিলাম। তোরাই কেবল তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিলি।”
অপমানটা বটুর ঠিক সহ্য হচ্ছিল না। সেও মন্তরতন্তরে বিশ্বাসী নয়, ডাকাবুকো লোক। সে হাতে হাত ঘষে দন্ত কিড়মিড় করে বলল, “কর্তা, যদি অনুমতি দেন আমি এ ব্যাটাকে একটু যাচাই করি।”
খাঁদু ককিয়ে উঠে বলল, “আর না, আর না। আমি হেরে গিয়েছি বলেই ধরে নিন না কেন।”