নরহরি বলল, “আমি শুনেছি।”
খাঁদু দেঁতো হাসি হেসে বলে, “তবেই বুঝুন, কলিযুগে পাপীতাপীরা কেমন তোফা আছে। খুনখারাপি, লুটমার করে দোহাত্তা কামাচ্ছে, তার উপর তাদের নিয়ে পালা হচ্ছে, গান বাঁধা হচ্ছে। এসব কি অশৈলী কাণ্ড নয় মশাই?”
“তা তো বটেই।”
“আর এই আমাকে দেখুন, গোবেচারা, ধর্মভীরু মানুষ। কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। খুন-জখম, চুরি-ডাকাতির ছায়াও মাড়াই না। তা কে দাম দিচ্ছে বলুন! সেই সাতসকালে বিষ্ণুপুর গ্রাম থেকে হাঁটা দিয়ে তিন মাইল ঠেঙিয়ে আসছি, খিদের চোটে পেট খোঁদল হয়ে আছে, তেষ্টায় বুক অবধি ঝামা, তবু কোনও ভালমানুষ কি একবারও ডেকে বলল, “ওরে বাপু খাঁদু, আয় বাবা, এই ঠান্ডার সকালটাতে এক পাত্তর গরম চা আর দু’খানা বাসি রুটি খেয়ে আত্মারামটা একটু ঠান্ডা কর বাবা। কিন্তু মশাই, আজ যদি আমার শ্রদ্ধাস্পদ খুড়োমশাই রাখালহরি গড়াই হাতে একখানা রাম-দা বাগিয়ে এসে দাঁড়াতেন, তা হলে দেখতেন, খাতির কাকে বলে! এতক্ষণে গরম গরম ফুলকো লুচি আর মোহনভোগ, সঙ্গে রসগোল্লা-পান্তুয়ার গাদি লেগে যেত। গাঁ ঝেটিয়ে পিলপিল করে লোক ধেয়ে আসত একবার চোখের দেখা দেখতে।”
কাশীবাবু তটস্থ হয়ে লজ্জিত মুখে বললেন, “আহা, তুমি চা-রুটি খেতে চাও, সেকথা আগে বলতে হয়! খিদে-তেষ্টা কার নেই বলো!”
পিছন থেকে নরহরি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে চাপা স্বরে বলল, “কর্তা, খাল কেটে কুমির আনছেন কিন্তু। এ লোক মোটেই সুবিধের নয়। কেমন চোর-চোর চেহারা, দেখছেন না। তার উপর ডাকাতের ভাইপো ! ডাকাতের ভাইপোরা কিন্তু ভাল লোক হয় না।”
কাশীবাবু মুখ ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলেন, “তুই ক’টা ডাকাতের ভাইপো দেখেছিস?”
“কেন, আমাদের কেষ্টপুরের পটল দাস! আমার বুড়ি ঠাকুরমা সারা সকাল কত কষ্ট করে গোবর কুড়িয়ে এনে ঘুটে দিতেন, আর বেবাক খুঁটে চুরি করে নিয়ে যেত ওই পটলা। মুদির দোকানে বাকি ফেলে জন্মে শোধ দিত না। আর নরেনবাবুর পোষা বিড়ালটা একখানা মাছের কাঁটা চুরি করেছিল বলে কী ঠ্যাঙার বাড়িটাই না মারল। এই পটলা হল কালু ডাকাতের সাক্ষাৎ ভাগনে।”
“তবে! ভাইপো আর ভাগনে কি এক হল? তুই যে মুড়ি আর মিছরির এক দর করে ফেললি? কালিয়া আর কোপ্তা কি আর এক জিনিস রে বাপু! ব্যাটবল আর বটব্যালে কি তফাত নেই? কিন্তু তোকে বলে কী লাভ, তুই তো সেদিনও সিন্নি খেয়ে বললি, ‘পায়েসটা বড় জম্পেশ হয়েছে!’ভাগনে আর ভাইপোর তফাত তুই কী বুঝবি?”
“আজ্ঞে, ভাগনে পছন্দ না হলে হাতের কাছে ভাইপোও মজুত রয়েছে। আমাদের গাঁয়ের গিরিধারীর কথাই ধরুন! গিরিধারী হচ্ছে। যেমন ষণ্ডা, তেমনই গুন্ডা, তার অত্যাচারে কত লোক যে গাঁ ছেড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। একে ধাঁই করে ঘুসি মারছে, তাকে ঠাস করে চড় মারছে, রামহরি কবরেজের চুল ধরে এমন টান মারল যে, চুলের গোড়াসুন্ধু উঠে আসার কথা। তা ভাগ্যিস রামহরি কবরেজ পরচুলো পরত, তাই পরচুলার উপর দিয়েই গেল। রামহরির যে টাক ছিল, তা কেউ জানত না। পরচুলা খসে যাওয়ায় জানাজানি হতে রামহরিও লজ্জায় গাঁ ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেল। তা সেই গিরিধারী হল নবকেষ্ট চোরের সাক্ষাৎ ভাইপো।”
“চোর!” বলে নাক সিঁটকোলেন কাশীবাবু। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “তোর বড় ছোট নজর। কথা হচ্ছে ডাকাতের ভাইপো নিয়ে, তুই ফট করে চোরের ভাইপোকে এনে ফেললি। ওরে, আদার সঙ্গে কি কাঁচকলা মেলে! নাকি আমের দামে আমড়া বিকোয়!”
এই সময়ে হঠাৎ একটা বাজখাঁই গলা সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, “অ্যাই! কী নিয়ে এত কথা হচ্ছে রে! গন্ডগোল কীসের?”
কাশীরামবাবুর বাবা নসিরামের চেহারাখানা দেখবার মতোই। ছ’ফুট লম্বা, বিশাল কাঁধ, মুগুরের মতো দুখানা হাত, প্রকাণ্ড তাগড়াই গোঁফ, মাথায় সিংহের কেশরের মতো কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল। এখনও রোজ বৈঠক করেন, ডাম্বেল বারবেল করেন, মুগুর ভাঁজেন, প্রাতভ্রমণ সান্ধ্যভ্রমণ তো আছেই। এইমাত্র মাইল পাঁচেক প্রাতভ্রমণ করে ফিরলেন। গায়ে পুরোদস্তুর মিলিটারি পোশাক, পায়ে ভারী মিলিটারি বুট। একসময় যে মিলিটারিতে ছিলেন, সেটাই সবাইকে সব সময়ে সমঝে দেন আর কী?
কাশীবাবু তাঁর বাবাকে যমের মতো ভয় খান। এখনও চোখের দিকে চেয়ে কথা কন না। বাবার জেরার জবাবে মিনমিন করে বললেন, “না, এই ডাকাতের ভাইপো নিয়ে কথা হচ্ছিল।”
নসিরাম গর্জন করে উঠলেন, “ডাকাত! কোথায় ডাকাত?”
নরহরি তাড়াতাড়ি খাঁদুকে দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আজ্ঞে, এই যে, ইনিই!”
“বটে! যা তো, দৌড়ে গিয়ে কোদালটা নিয়ে আয়।”
নরহরি অবাক হয়ে বলে, “কোদাল! কোদাল দিয়ে কী হবে কর্তাবাবা?”
বাঘা চোখে চেয়ে নসিরাম বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “কোদাল দিয়ে বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা তিন হাত লম্বা দেড় হাত চওড়া গর্ত খুঁড়ে ফ্যাল শিগগির। এই ডাকাতটাকে আজ জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।”
কাশীরাম তটস্থ হয়ে বললেন, “বাবামশাই, এই প্রাতঃকালেই খুনখারাপি কি ভাল দেখাবে?”
নসিরাম গর্জে উঠলেন, “কেন, প্রাতঃকালে ডাকাতকে জ্যান্ত পুঁতলে দোষ হচ্ছে কোথায়?”
“আজ্ঞে, এ ঠিক ডাকাত নয়। ডাকাতের ভাইপো!”
“ওই একই হল। যা, যা, তাড়াতাড়ি কোদাল এনে গর্তটা করে ফ্যাল তো নরহরি!”